মোহরানা বা দেনমোহর বা কাবিনের টাকা বা কাবিন স্বত্ব যে নামেই আমরা ডাকি না কেন, বিয়ের সময় আমরা বৈধ ভাবে অফিসিয়ালি যে আর্থিক লেনদেন করে থাকি, তাকেই মূলত দেনমোহর বলে থাকে। তবে, দেনমোহরের যথোপযুক্ত সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ডিএফ মোল্লা বলেন, ‘মোহর বা মোহরানা হল কিছু টাকা বা অন্য কিছু সম্পত্তি যা বিয়ের প্রতিদান স্বরূপ স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী পাওয়ার অধিকারিণী। তাছাড়া, মোহরানা হচ্ছে স্ত্রীর প্রতি সম্মানের প্রতীক’।
তাছাড়া দেনমোহরকে আরও বেশি বাধ্যতামূলক করতে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে আদায় যোগ্য করার জন্য ২১ ডিএলআর ২১৩ তে বলা হয়েছে যে, বিয়ে রেজিস্ট্রি হোক বা না হোক স্ত্রী দেনমোহর পেতে অধিকারিণী। তবে, রেজিস্ট্রি হয়নি এমন বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
আমাদের সমাজে বিয়ের অন্যান্য বিষয় নিয়ে উভয় পক্ষের যখন কোন খটকা বা দ্বিমত থাকে না, ঠিক তখনি বিপত্তি সৃষ্টি হয় বিয়ের দেনমোহর নিয়ে। দেনমোহর হচ্ছে স্ত্রীর হক। স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করা স্বামীর উপর ফরজ। আল্লাহ তা’আলা সূরা নিসার ৪ নাম্বার আয়াতে বলেন, “আর তোমাদের স্ত্রীদের তাদের দেনমোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। অবশ্য স্ত্রী চাইলে দেনমোহর কিছু অংশ কিংবা অংশ ছেড়ে দিতে পারে।” স্ত্রী যদি মাফ করে দেয় বা দেনমোহর খুশী মনে ছেড়ে দেয়, তাহলে তো কোন সমস্যা নাই, কিন্তু এর জন্য স্ত্রীকে কোন ভাবে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। আমাদের দেশে যেহেতু বিয়ের সময় পুরো দেনমোহর পরিশোধ করা লাগে না, কিছু অংশ উশুল হিসেবে দিয়ে বাকিটা বকেয়া রাখা যায়, সেহেতু কেউ যদি আবার মনে করে যে, বাকী অংশ সে পরিশোধ করবে না, তাহলে এই হাদিসটি তার জন্য, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তির কোন মেয়েকে দেনমোহর দেওয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে কিন্তু দেনমোহর দেওয়ার ইচ্ছে নেই, সে কেয়ামতের দিন আল্লাহ্র নিকট ব্যভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে- মুসনাদে আহমাদ। অতএব, দেনমোহর নিয়ে কোন প্রকারের চালাকি চলবে না। তাই, স্ত্রীকে হালাল ভাবে উপভোগ করতে দেনমোহর যখন দিতেই হবে, সেহেতু কোন প্রকার প্রতারণা ছাড়াই সেটি পরিশোধ করা উচিত।
বর পক্ষ যখন দেনমোহর পরিশোধ করতে উৎসাহী তখন সেখানে ঝামেলা পাকায় কণে পক্ষের লোকজন। অতি উচ্চ মাত্রায় দেনমোহর দাবী করে বসে যা কিনা বরের সামর্থ্যের বাহিরে। তাই ধর্ম দেনমোহর নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে, কণের বোন, খালা বা ফুফুদের বিয়ের সময় নির্ধারিত দেনমোহরের পরিমাণকে বিবেচনা করা উচিত। আবার, কণের পিতার আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, আমাদের সমাজে এখন একটা কথা প্রচলিত যে, ‘মার্কেটে এখন এতো কাবিনই চলছে বা এর নীচে কেউই দেনমোহর নেয় না’ ইত্যাদি বিভিন্ন কথা বলে থাকে যেখানে নারীর সম্মান বৃদ্ধি পায়ই না বরং নারীকে পণ্যের ন্যায় তুলনা করা হচ্ছে। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমাদেরকে বিয়েতে উভয়ের স্বার্থ এবং মর্যাদা বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত।
এবার আসুন দেনমোহর পরিশোধ নিয়ে কিছু কমন প্রশ্নের উত্তর জানি। একটা প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন যে, স্ত্রী যদি নিজ থেকে স্বামীকে তালাক দেয়, তাহলে কি স্বামীকে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে? উত্তর হচ্ছে, জি হ্যাঁ। দেনমোহর যেহেতু স্ত্রীর হক, সেহেতু তালাক যে পক্ষ থেকেই দেওয়া হোক না কেন, স্বামী দ্বারা স্ত্রীকে স্ত্রীর প্রাপ্য হক আদায় করতে হবে। অর্থাৎ, স্ত্রী তালাক দিলে স্বামীকে আর দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে না বলে আমাদের সমাজে যে ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে, তা ভুল, অসত্য, অবান্তর। মনে রাখতে হবে, দেনমোহর হচ্ছে স্ত্রীর অধিকার যা কিনা পরিশোধ করার পূর্ব পর্যন্ত তা স্বামীর জন্য ঋণ।
আরেকটি বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে বিতর্ক রয়েছে যে, বিয়ে হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে বা সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে তালাক বা বিচ্ছেদ বা স্বামী মারা গেলে স্ত্রী কি স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহরের পুরো টাকা দাবি করতে পারবেন কিনা?– বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পুরো দেনমোহরের টাকা পাওয়ার জন্য পূর্ণ হকদার। তবে, আরও স্পষ্ট করে বললে বলবো, যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের পর সহবাস তথা শারীরিক সম্পর্ক সম্পন্ন হয়, তাহলেই স্বামী তার স্ত্রীকে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতেই হবে। কেননা আইনানুসারে, বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মাঝে সহবাস সম্পন্ন হওয়ার আগেই যদি তালাক বা বিচ্ছেদ বা স্বামী মারা যায়, তবে স্বামীকে দেনমোহরের পুরো টাকা পরিশোধ করতে হবে না। সেক্ষেত্রে স্বামীকে কেবল দেনমোহরের অর্ধেক টাকা পরিশোধ করতে হবে।
এবার আসুন দেনমোহর পরিশোধের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানি। বিবাহ বলবত থাকাবস্থায় যেকোনো সময় যেমন দেনমোহর আদায় করা যাবে, তেমনি বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর পরও দেনমোহর আদায় করা যায়। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় এবং প্রচলিত হচ্ছে, বিবাহ বিচ্ছেদের পর দেনমোহর আদায় প্রক্রিয়া। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, ঘরোয়া পরিবেশে উভয় পক্ষ বসে দেনমোহরের টাকার পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখে বা নিজেদের মাঝে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করে এককালীন বা কয়েক দাপে পরিশোধ করতে পারবে। আর যদি ঘরোয়া পরিবেশে সমঝোতা না হয় তবে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। সেক্ষেত্রে, দেনমোহরের মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে স্ত্রী কিন্তু ভালো সময় পাবেন। স্বামী স্ত্রীর মাঝে তালাক হওয়ার দিন থেকে বা স্বামীর মৃত্যুর ৩ বছরের মধ্যে পারিবারিক আদালতে দেনমোহর আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করতে হবে। অনেকেই মনে করেন যে, স্বামী মারা গেলে তার কাছ থেকে কিভাবে দেনমোহরের টাকা আদায় করবে? আরে ভাই, আপনি যদি কারো কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মারা যান, তাহলে আপনার সাথে সাথে আপনার ঋণের চ্যাপ্টারও কি ক্লোজ হয়ে যাবে? বা আরও সহজ করে ভাবুন, আপনি একটা লোকের কাছে টাকা পাবেন, সেই লোক টাকা পরিশোধ করার আগেই মারা গেছে, আপনি কি ঐ টাকা আদায় করতে তার পরিবার তথা উত্তরাধিকারের কাছে যাবেন না? ঠিক তেমনি, স্বামী দেনমোহরের টাকা পরিশোধ না করে মৃত্যুবরণ করলে, স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে বা তার উত্তরাধিকারদের এটা পরিশোধ করতেই হবে। অনেক সময় যখন স্বামীর উত্তরাধিকার বলতে কোন সন্তান না থাকে, তখন স্বামীর ভাই বোন বাবা মা উত্তরাধিকার হয়ে থাকে। তারা যদি মৃত ব্যক্তির ঋণ বা স্ত্রীর দেনমোহরের হক পরিশোধ না করে তবে স্ত্রী চাইলে উত্তরাধিকারদের বিরুদ্ধেও মামলা করতে পারবে। একই ভাবে যদি স্ত্রীর মারা যায় দেনমোহরের হক আদায় না করে, তবে স্ত্রীর উত্তরাধিকাররাও মামলা করে দেনমোহরের হক আদায় করে নিতে পারবে। কারণ, দাতা বা গ্রহীতার মৃত্যুতে এই ঋণ বিলুপ্ত হবে না; একমাত্র স্ত্রী কর্তৃক না-দাবী বা মাফ করে দেওয়ার ব্যতীত।
সবশেষে বলতে চাই, আমাদের সমাজে এখন বিয়ে হয়ে গেছে কঠিন, যার ফলে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক তথা ব্যভিচার হয়ে গেছে সহজ। অথচ, হওয়ার কথা ছিল উল্টো। অর্থাৎ, বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সহজ, তখন ব্যভিচার, পরকীয়া, লিভ টুগেদার এসব হয়ে যেত কঠিন। আসুন বিয়েকে সহজ করি এবং সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করি।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )