বিয়ের বয়স

বাংলাদেশে বিয়ের ন্যূনতম বয়স কত?

পারিবারিক আইন

স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা নাটক সিনেমা দেখে, গল্প উপন্যাস পড়ে প্রেম ভালোবাসার মোহে পড়ে অনেকসময়ই পরিবারের অমতে সাবালক সাবালিকা হওয়ার পূর্বেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে পেলে। আবার, অনেক সময় মেয়ের অভিভাবকরা ভালো পাত্র, সুপাত্র পেয়ে গেলে মেয়ের বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে দিয়ে দেয়। এই ধরনের বিয়ে গুলোকে আমরা সাধারণত বাল্যবিবাহ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি। আর এই বাল্যবিবাহ নিয়ে আমাদের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সংশয়। বাল্যবিবাহ আমরা হয়ত সবাই বুঝি যে সাবালক বা সাবালিকা হওয়ার আগে কোন বিবাহ সম্পন্ন হলে সেটাকেই বাল্যবিবাহ বলা হবে। কিন্তু, ঠিক কখন কে সাবালক, কে সাবালিকা বা কখন একজন মানুষ সাবালক বা সাবালিকা হবে এই সময়সীমা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব। আজ আমরা এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করার চেষ্টা করবো।
বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং বিয়ে যেহেতু পার্সোনাল/ব্যক্তিগত তথা ধর্মীয় আইন অনুসারে হয়ে থাকে, সেহেতু এই বিয়ের বয়স নিয়ে রয়েছে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব। কেননা, ধর্মীয় আইন অনুসারে বিয়ের বয়সকে সংখ্যা দিয়ে নির্ধারণ করে না দিলেও রাষ্ট্রীয় আইনে বিয়ের বয়সকে সংখ্যায় বেঁধে দিতেই হয়, নাহলে সময়ে সময়ে তৈরি হবে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা যা একে একে সামাজিক অবক্ষয়ের জন্ম দিবে। ইসলাম ধর্ম অনুসারে আমাদেরকে কোরআন-হাদিসের আলোকেই চলতে হবে।

আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন: “তোমাদের মধ্যে যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা কর, তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ ও যোগ্য তাদেরও। তারা যদি দরিদ্র হয় তাহলে আল্লাহ্‌ই নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ্‌ মহা দানশীল, মহাজ্ঞানী।”[সূরা নূর, আয়াত: ৩২]
অন্য আয়াতে আবার মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা তাদের অভিভাবকদের অনুমতিক্রমে তাদের বিয়ে করো, যথাযথভাবে তাদের মোহর প্রদান করো, যেন তারা বিয়ের দুর্গে সুরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে এবং অবাধ যৌন চর্চা ও গোপন বন্ধুত্বে লিপ্ত হয়ে না পড়ে।”(সূরা নিসা-২৫)

কোথাও কিন্তু, বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন বয়সকে মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়নি। তাছাড়া, আমাদের প্রিয় নবী (সা:) স্বয়ং নিজে যখন মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে বিয়ে করেন তখন মা আয়েশার বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর; যদিও বিয়ের আরও ৩ বছর পর অর্থাৎ মা আয়েশা ৯ বছর বয়সে নবী করিম (সা:) এর ঘর সংসার করেছেন। (সহীহ বুখারী হাদিস নং ৪৮৪০, সহীহ মুসলিম/ ১৪২২)
এতটুকুতেই প্রতীয়মান হয় যে, বিয়ের জন্য ধর্মানুসারে কোন বয়স নির্ধারিত নেই। কিন্তু, যুগের পরিক্রমায় দেখা গেছে যে, বিয়ের জন্য বয়স একটা মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ে সময়ে মানুষের মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তনও ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলতে চাইছেন, আঠারোর আগে বিয়ে নয়, বিশের আগে সন্তান নয়। কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন, নাবালিকা মেয়ের শারীরিক দুর্বল যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সংসার জীবনে প্রবেশ করলে শিক্ষা সম্পন্ন করতে না পারার অনিশ্চয়তা। তার উপর, বিশ্বব্যাপী এখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে রাষ্ট্রগুলো। সব মিলিয়ে বিয়েতে যেমন বাল্যবিবাহ রোধ করতে চাচ্ছে, চাচ্ছে সন্তান জন্মদানেও কিছুটা বিলম্ব। যার ফলশ্রুতিতে নির্ধারণ করা হয়েছে বিয়ের বয়স।



বিয়ের বয়স বুঝতে হলে আপনাকে বুঝতে হবে কোনটা বাল্যবিবাহ নয়। যেটা বাল্যবিবাহ নয়, সেটাই বৈধ বিবাহ(রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে)। ব্র্যাকেটে রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিয়ে কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপার। কেউ এখন আমাকে সাম্প্রদায়িক বলে গালি দিতে চাইলে তাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ের বেলায় কিন্তু ঠিকই হিন্দু মুসলিমের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রীতি। কারণটাও স্পষ্টত, বিয়ে ধর্মীয় বিষয়। ধর্ম যেভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছে, সেই অনুসারেই আপনাকে বিয়ে করতে হবে। এখন ধর্মীয় ভাবে বিয়ে হলেও কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন করতে মানতে হবে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ। তাই, কাজীকে ডেকে বিয়ে পড়ানোর সময় কাজীকেও মানতে হবে বিয়ের জন্য বর কণের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া বয়স-সীমা।

২০১৭ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ২ নং ধারার ৪ নং উপধারায় বাল্যবিবাহের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ২ নং ধারার ৪ নং উপধারায় বলা হয়েছে যে, “বাল্যবিবাহ”অর্থ এইরূপ বিবাহ যার কোন এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’। অর্থাৎ, যখন কোন বিয়ের এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ অপ্রাপ্ত বয়স্ক হবে, তখন সেই বিয়েকে আইনত বাল্যবিবাহ বলা হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’ কারা?
এর উত্তরও পাওয়া যাবে, একই আইনের ২ নং ধারার ১ নং উপধারায়। ২ নং ধারার ১ নং উপধারায় বলা হয়েছে, “অপ্রাপ্ত বয়স্ক”অর্থ বিবাহের ক্ষেত্রে ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো নারী। অর্থাৎ, কোন বিয়েতে বর তথা পুরুষের বয়স ২১ এর কম বা কনে তথা নারীর বিষয় ১৮ এর কম হলেই ঐ বিয়ে বাল্যবিবাহ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এবার সোজা বাংলায় বললে দাঁড়ায়, বিয়ের জন্য বরের বয়স হতে হবে অন্তত ২১ এবং কনের বয়স হতে হবে ১৮। কিন্তু, আইন থাকা সত্ত্বেও মানা হচ্ছে না এর বিধিনিষেধ। তাই, বাল্যবিবাহের জন্য বর-কণের শাস্তিরও বিধান রাখা হয়েছে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে।

আমাদের দেশে যেটি সবচেয়ে বেশি অহরহ বা কমন কেস সেটি হচ্ছে, বর প্রাপ্ত বয়স্ক আর কনে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর ৭ ধারা অনুসারে, বর যদি প্রাপ্ত বয়স্ক হয় আর কনে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, তাহলে উক্ত বাল্যবিবাহের অপরাধে বরকে অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে এবং কনে যেহেতু অপ্রাপ্ত বয়স্ক সেহেতু তাকে অনধিক ১ মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তি প্রদান করা যাবে। অর্থাৎ, বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করেছে এমন ক্ষেত্রে বর হোক বা কনে যে প্রাপ্ত বয়স্ক তার শাস্তি অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড, অন্যদিকে যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক তার শাস্তি অনধিক ১ মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের।

শুধু বর-কনেকে শাস্তি দিলেই তো হবে না, যখন বিয়ে হবে পারিবারিক ভাবে তখন ঐ বিয়ের অভিভাবক বা পিতা মাতাকেও বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করানোর অপরাধে অনধিক ২ বছর ও অন্তত ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
বর কনে শাস্তি পাবে, শাস্তি পাবে পিতা-মাতা অভিভাবকও, তাহলে কেন বাদ যাবে যে ঐ বিয়ে নিবন্ধন করবে?
কেউ পাবে, কেউ পাবে না,
তা হবে না, তা হবে না।

তাই, যে ধর্মীয় রীতিতেই বিয়ে হোক না কেন, বিয়ে যে রেজিস্ট্রি তথা নিবন্ধন করবেন, তিনি যদি বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ২ বছর ও অন্তত ৬ মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার লাইসেন্স বা নিয়োগ বাতিল করা হবে। তাই সর্বোপরি আসুন, বাল্যবিবাহ না করে রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে বিয়ের বয়স হলেই কেবল বিয়ে সম্পন্ন করি।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.