তালাক নোটিশ

তালাক নোটিশ পাঠানোর পর আপোষ/সমঝোতা

পারিবারিক আইন

পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কারাগার কোনটি জানেন?
পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কারাগার বা জেল হচ্ছে, ঐ পরিবারটি, যে পরিবারে অশান্তি লেগে থাকে। আপনি সারা দুনিয়া ঘুরে আসার পর আপনার পরিবারের কাছেই একটি আশ্রয়, বিশ্রাম বা স্বস্তি পেতে চাইবেন, কিন্তু আপনার পরিবারে এসে যদি আপনি শান্তির পরিবর্তে অশান্তি পেয়ে থাকেন, তখন আপনার কাছে আপনার পরিবারকে নিকৃষ্টতম কারাগার মনে হবে। কেননা, সব জায়গায় না গিয়ে থাকা গেলেও পরিবার ছেড়ে মানুষ বাঁচতে পারে না, ঘুরে ফিরে পরিবারের কাছেই ফেরত আসতে হয়।

তেমনি একটি পরিবার হচ্ছে, সুমন এবং সুমির পরিবার। ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। সব পরিবারেই কম বেশি বনিবনা না হওয়ার সমস্যা থাকে। কেউ আছে ধৈর্য আর বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মতের অমিল হওয়াটাকে ঠেকিয়ে রাখেন। আবার কেউ কেউ হয়তো ধৈর্য এবং বোধশক্তি কম থাকার কারণে ছোটখাটো বিষয় নিয়েই ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়েন।
বলা হয়ে থাকে, সংসার করতে হলে একজন যদি আগুন হয় আরেকজনকে পানি হতে হয়। উভয় পক্ষ যদি আগুন হয়ে যায় তখন সেই সংসার পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। এখন কথা হচ্ছে, কেউই পানি হতে চায় না, কেউই একজনের কথা শুনে ধৈর্য ধরতে না চায়, শুনতে না চায়, তখন ঐ সংসার টিকিয়ে রাখা আদৌ কি সম্ভব?

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংসার ভেঙে যাওয়ার পর অনেকেরই বক্তব্য হচ্ছে এমন যে, আমি যদি ঐ কথাটা না বলতাম বা ও যদি ঐ কথাটা আমাকে না বলতো, তাহলে হয়তো সংসারটা টিকে যেত। ছোটখাটো একটি দু’টি কথাই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করে দেয়।
আপনি নিজেও দেখবেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা রাগের মাথায় এমন সব কথা বলি, যে কথাগুলো আমরা যখন সুস্থ মস্তিষ্কে বা ঠাণ্ডা মেজাজে থাকি, তখন কখনোই বলি না। তাই নিয়ম হচ্ছে একজন রেগে গেলে আর একজন চুপ থাকা। যখন রেগে যাওয়া ব্যক্তির রাগ পড়ে যাবে, তখন তাকে বুঝিয়ে নিজের যুক্তিটা তুলে ধরা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করা। উভয় পক্ষ যদি রেগে যায় সে ক্ষেত্রে কখনোই ভালো সমাধান আশা করা যায় না।

যাই হোক, আমাদের গল্পের নায়ক নায়িকা সুমন এবং সুমি উভয়ে দাম্পত্যে জীবনে বেশ ভাল না থাকলেও বৃহৎ কোন সমস্যা ছিল না। তবে, মাঝে মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে ছোটখাটো বিরোধ হত, আবার ঠিকঠাক মিটেও যেতো। তবে একদিন ঝগড়া এমন পর্যায়ে পৌঁছল যখন সুমন তুমি থেকে তুইতে নেমে আসলো এবং সামান্য হাতাহাতিও হল।
তাৎক্ষণিক সুমি সিদ্ধান্ত নিল, সে আর সংসার করবে না। সুমি বাবার বাড়ি চলে যায় এবং সুমন বহু চেষ্টা করেও সুমির রাগ ভাঙাতে পারেনি। তার কয়েকদিনের মাথায় সুমন দেখতে পেল সুমনের ঠিকানায় সুমি তালাক নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছে।

সুমন ভাবেনি এতো কিছু হয়ে যাবে, আর সে নিজে তালাক চাচ্ছিল না। ঘরোয়া ভাবে তাই সমঝোতা করার চেষ্টা শুরু করলো। স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করলে সুমি তার ফোনই ধরত না। তবে উভয়পক্ষের অভিভাবকরা বেশ উদার মনের ছিলেন। তারা ছেলেমেয়েদের কথায় কান না দিয়ে উভয় পক্ষ উভয়পক্ষকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন যাতে সংসার না ভাঙ্গে।
একটা স্বল্প বিরতির পর সুমিও বুঝতে পারে যে, সে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত রিয়েক্ট বা প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছে। সুমি রাগের মাথায় তালাক পাঠিয়ে দিয়েছে, যা এখন মনে হচ্ছে ঠিক হয়নি। মুরুব্বীদের মধ্যস্থতায় সুমি রাজি হয়েছেন যে, সে নোটিশ প্রত্যাহার করে নিবে এবং পুনরায় সংসার করবে; কেননা সুমন ইতিমধ্যে sorry বলেছে এবং নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছে।

এখন তালাক নোটিশ পাঠানোর পরে তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করে পুনরায় সংসার করা যায় কিনা, আজ আমরা সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করবো।
সাধারণত আমরা জানি যে, মুসলিম আইন অনুসারে, কোন স্বামী বা স্ত্রী যদি তার স্ত্রী বা স্বামীকে তালাক দিতে হয়, সেক্ষেত্রে তালাক নোটিশ পাঠাতে হয়; দুটি তালাক নোটিশ।
প্রথমত, স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেয় তাহলে স্ত্রীর ঠিকানায় একটি নোটিশ পাঠাবে। আর যদি স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেয় সেক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর ঠিকানায় একটি তালাক নোটিশ পাঠাবে।
আর দ্বিতীয় তালাক নোটিশটি পাঠানো হবে সালিশি পরিষদ বরাবর। একপক্ষ আরেকপক্ষকে যে তালাক দিচ্ছে, আরেকপক্ষ বা অপরপক্ষ যে সালিশি পরিষদের অধীনে রয়েছে অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের যেখানে থাকবে, সেখানকার চেয়ারম্যান বা মেয়র বরাবর একটি নোটিশ পাঠাতে হবে।

তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরে উক্ত তালাক কার্যকর হয়। এখন কোন দম্পতি নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, বনিবনা না হওয়া, রাগের মাথায় বা অন্য যে কোনও কারণে যদি একে অন্যকে তালাক নোটিশ পাঠিয়ে দেয় এবং তার কিছুদিন পরে তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে যদি নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন এখনও পার না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তারা চাইলে ওই সালিশি পরিষদ থেকে তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করে নিয়ে পুনরায় সংসার করতে পারে। এক্ষেত্রে তাদেরকে পুনরায় বিবাহ করার কোনও প্রয়োজন নেই।

কিন্তু কোনও কারণে যদি ৯০ দিন পার হয়ে যায় এবং ৯০ দিন পরে যদি তাদের মধ্যে সমঝোতা হয়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে পুনরায় বিবাহ করতে হবে। কারণ আইনত তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, তালাক নোটিশ পাঠানোর সময় যদি স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সাধারণত তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন এবং সন্তান জন্ম নেওয়ার মধ্যে যেটি পরবর্তীতে ঘটবে, সেদিন তালাক কার্যকর হয়ে।

 

তবে, তালাক কার্যকর হয়ে যাওয়ার পর যদি স্বামী স্ত্রীর নিজেদের মধ্যে আপোষ হয় এবং পুনরায় সংসার করতে চায় সেক্ষেত্রে তাদেরকে পুনরায় বিবাহ করতে হবে। অতীতে হিল্লা বিবাহ করার প্রচলন থাকলেও বর্তমানে হিল্লা বিবাহ নিষিদ্ধ। তাই একই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হয়ে যাওয়ার পরে যদি পুনরায় বিবাহ করতে ইচ্ছা হয়, সেক্ষেত্রে মাঝখানে হিল্লা বিবাহ করার কোনও প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেই হল।
সবশেষে, রাগের মাথায় তালাক দেওয়া আমাদের দেশে একটা প্রচলিত ট্র্যাডিশন। রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেকটা সমস্যার সমাধানের উপায় থেকে বিরত হওয়ার মতো। রাগ আমাদের মানসিক অবস্থার অস্থিরতা এবং বিরক্তি সৃষ্টি করে এবং এটি সাধারণত শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই, একজনের রাগ হলে আরেকজন চেষ্টা করবেন রাগ থামানোর। আর রাগ থামানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, চুপ থাকা।

একজন রেগে গেলে তার মুখ দিয়ে যা তা বের হবে, যেগুলো সে হয়ত সুস্থ মস্তিষ্কে কখনোই বলতো না। তাই ঐসব কথায় কান না দিয়ে বরং, চুপ থাকলে সে আপনাআপনিই একসময় থেমে যাবে। শুধু চুপ থাকলেই বেশির ভাগ ঝগড়ার মীমাংসা হয়ে যায় এবং পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর স্থান ‘পরিবারে’ সুখে বিদ্যমান থাকবে।
পরবর্তী পর্বে আমরা তালাক নোটিশ প্রত্যাহারের নমুনা এবং নোটিশ না পাঠানোর সমস্যা নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্‌।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.