সমরেশ মজুমদারের লেখা উত্তরাধিকার উপন্যাসটি পড়েছিলেন, মনে পড়ে সেই অনিমেষকে? উত্তরাধিকার বলতে আমরা যা বুঝি, ছেলে সন্তান সেটাকে অনেকটাই পরিপূর্ণতা দেয়। মেয়েদেরকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই; কিন্তু সত্যিকার অর্থে মেয়েদের বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ার কারণে উত্তরাধিকার হিসেবে নিজের পৈত্রিক বাড়ি দখল ও দেখভাল করার যে বিষয়টা সেটা ঘুরেফিরে ছেলেদের কাঁধেই এসে বর্তায়। জমি জমা ছাড়াও ব্যবসা বাণিজ্যও সঠিকভাবে দেখভাল করতে পারে বলে ছেলে সন্তান হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষের মনে বংশের প্রদীপ তথা উত্তরাধিকার নিয়ে একটা টেনশন কাজ করতে থাকে। যদিও নারী পুরুষ এখন সমান, মেয়ে সন্তানকে নিয়ে মানুষের আগের মত আর দুশ্চিন্তা কাজ করে না কিন্তু ছেলে সন্তান সেই পুরনো আমল থেকেই উত্তরাধিকার হিসেবে যোগ্য উত্তরসূরির ভূমিকা পালন করে আসছে। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে, কোন ব্যক্তির যদি একটি ছেলে সন্তান থাকে তাহলে তার সম্পত্তি আর বাহিরে যাওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। যেখানে কিনা একটি কন্যা সন্তান থাকলে প্রায় অর্ধেক সম্পত্তি বাহিরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সকলেরই চিন্তা থাকে একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেয়া এবং দুনিয়াতে তার যোগ্য উত্তরাধিকার রেখে যাওয়া। চলুন আজকে আমরা আলোচনা করবো, ছেলের উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তিতে অধিকার নিয়ে।
বাবা কিংবা মা, যার কাছ থেকে সম্পত্তি পেয়ে থাকুক না কেন, বাবা-মায়ের কাছ থেকেই ছেলে-মেয়ের সর্বদা একটি রেশিও বা অনুপাত অনুসরণ করতে হয় যা হচ্ছে, ছেলে যা পাবে মেয়ে তার অর্ধেক পাবে। কিন্তু যদি কোনো মেয়ে না থেকে থাকে সে ক্ষেত্রে এক বা একাধিক ছেলে পুরো সম্পত্তির অধিকারী হবে। মজার বিষয় হচ্ছে, মুসলিম উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টন এর জন্য প্রথম যে তালিকা রয়েছে (শেয়ারার), সেই তালিকায় ছেলের নাম নেই। ছেলের নাম রাখা হয়েছে রেসিডিউরারি বা আসাবা তালিকায়। শেয়ারার তালিকায় যারা রয়েছে তাদের প্রত্যেককে দেওয়ার পর যদি কোনো সম্পত্তি অবশিষ্ট থেকে থাকে তাহলে সেটি ছেলে পাবে। কিন্তু উত্তরাধিকার আইনে আরেকটি নীতি রয়েছে যে, একজনের উপস্থিতি আরেকজনকে বিতাড়িত করে। ছেলে থাকলে অনেকেই বিতাড়িত হয়ে যায়, যার কারণে প্রথমে তালিকাতে ছেলের নাম না থাকলেও প্রথম তালিকার অনেকেই ছেলের উপস্থিতির কারণে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের সবচেয়ে সহজ হিসাব হচ্ছে, শেয়ারার লিস্টের বারোজনের প্রত্যেককে দেওয়ার পরে অবশিষ্ট যতটুকু অংশ থাকবে তার পুরোটাই ছেলেকে দেওয়া হবে। ১২ জনের লিস্ট নিয়ে আমরা আরেকটি আর্টিকেলে বিস্তারিত লিখব। কিন্তু এটা মনে রাখবেন ছেলে যখন থাকে তখন আশেপাশে অনেকেই সম্পত্তি তেমন পায় না। বাবা মারা গেলে বাবার উত্তরাধিকার হিসেবে মায়ের একটা অংশ রয়েছে সেটি হতে মা বঞ্চিত হবে না আবার মা মারা গেলে মায়ের সম্পত্তি থেকে বাবার একটি অংশ রয়েছে সেটি থেকেও বাবা বঞ্চিত হবে না। এদের দেওয়ার পর প্রায় অবশিষ্ট পুরোটাই নিচের দিকে ছেলে মেয়ের কাছে চলে আসবে। তখন আর বোন-ভাই, দাদি-নানি, সৎ ভাই বোন ইত্যাদি কেউই সম্পত্তি পাবে না। মনে রাখবেন, মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীকে উত্তরাধিকার হিসেবে বঞ্চিত করা যায় না।
উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলের পজিশন সবচেয়ে পোক্ত। বাবা কিংবা মায়ের মৃত্যুর পর তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে শেয়ারারদের দেওয়ার পর ছেলেকেই সবকিছু দিতে হবে। ছেলের বিষয়ে শুধু একটা বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে যদি আপনার একাধিক সন্তানের মধ্যে আপনার জীবন দশায় আপনার কোন ছেলে মারা গিয়ে থাকে এবং ওই মৃত ছেলের সন্তানাদি থেকে থাকে সেই ক্ষেত্রে আপনার সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ছেলে সম্পত্তি পাবে কিনা এটা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। ১৯৬১ সালের আগ পর্যন্ত আপনি জীবিত অবস্থায় আপনার কোন ছেলে মারা গেলে কিন্তু আপনার নাতি নাতনি জীবিত থাকলে ওই নাতি-নাতনি সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হতো। কেননা আপনার ছেলে মারা গিয়েছে আপনি জীবিত থাকা অবস্থাতেই যার ফলে আপনার বাকি সন্তানরাই কেবলমাত্র ওয়ারিশ হিসেবে আপনার সম্পত্তি ভোগ দখল করতে বা মালিকানা অর্জন করতে পারবে। কিন্তু ১৯৬১ সালে Muslim Family Law Ordinance বা মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এখন আপনি জীবিত অবস্থায় যদি আপনার কোন ছেলে বা মেয়ে মারা যায় এবং তাদের ছেলে মেয়ে থেকে যায় সেক্ষেত্রে আপনার ছেলে-মেয়ে জীবিত থাকলে যতটুকু অংশ পেত, ঠিক ততটুকুই আপনার নাতি নাতনি পাবে। যদিও আমরা ছেলের উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তিতে অধিকার নিয়ে আলোচনা করছি কিন্তু এই ক্ষেত্রে মৃত ছেলের ছেলেমেয়েদের সম্পত্তিতে অধিকারের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আমরা এ বিষয়টিও সংক্ষেপে আলোচনা করে গেলাম; যদিও আমাদের ওয়েবসাইটের লা ওয়ারিশ প্রথা বাতিল প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনা রয়েছে, আপনি চাইলে বিস্তারিত পড়ে দেখতে পারেন।
এবার আসুন মায়ের বাবার বাড়ির সম্পত্তিতে ছেলের উত্তরাধিকার নিয়ে একটু দেখে আসি। পূর্বে একটি লাইনে উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলেকে সবচেয়ে স্ট্রং ক্যারেক্টার বলা হলেও ওই ছেলে যখন তার মায়ের সম্পত্তি আনতে নানার বাড়িতে যায় তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ে থাকে। যদিও অনেকেই সেটাকে বলবে যে সেটা তো তার সম্পত্তি না, সে তার মায়ের সম্পত্তি। কিন্তু তার মায়ের অবর্তমানে সম্পত্তির মালিক সেই ছেলে নিজে, মামার বাড়ি থেকে সম্পত্তি আনার ক্ষেত্রে এই স্ট্রং ক্যারেক্টারটাও দুর্বল হয়ে পড়ে, এর জন্য আপনাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে আপনার নানার সম্পত্তি একটা হিসেব বের করতে হবে, তারপর সেখান থেকে বাটোয়ারার মাধ্যমে আপনার মায়ের অংশ আলাদা করতে হবে, তারপর আপনার মায়ের অংশ উত্তরাধিকারসূত্রে আপনি মালিকানা অর্জন করতে পারবেন। ছেলে হিসেবে আপনার মায়ের সম্পত্তি আপনি নানার বাড়ি থেকে আদায় করার সবচেয়ে সঠিক উপায় হচ্ছে এটি। তবে মা জীবিত অবস্থায় নানার বাড়ির সম্পত্তি উদ্ধার করার চেষ্টা করাই উত্তম, না হলে প্রথমে আপনার মাকে মেয়ে হিসেবে আপনার নানার সম্পত্তি থেকে ভাগ নিতে হবে, তারপর ছেলে হিসেবে আপনার মায়ের কাছ থেকে নিতে হবে। তাই, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের বিষয়টি ব্যক্তি মারা যাওয়ার পরপরই শুরু করা উচিত। যদি দেখতে বা শুনতে খারাপ লাগে, তবুও সরেজমিনে ভাগ না করলেও কাগজপত্রগুলো ঠিকঠাক করে নিজ-নিজ নামে করে ফেললে পরে আর কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না।
এই ছিল ছেলে হিসেবে বাবা এবং মায়ের সম্পত্তি থেকে উত্তরাধিকার। আশা করি বুঝতে পেরেছেন, তারপরও কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে আমাদেরকে ই-মেইল ( tanbir@legalfist.com ) করে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )