লা ওয়ারিশ প্রথা বাতিল হওয়ার কারণে বর্তমানে দাদা জীবিত অবস্থায় বাবা মারা গেলে নানি নাতনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয় না, বাবা জীবিত থাকলে যতটা সম্পত্তি পেতো ঠিক ততটাই পায়। এই নীতি প্রযোজ্য হচ্ছে, নানা জীবিত অবস্থায় মা মারা গেলেও নাতি নাতনিরা মা জীবিত থাকলে যতটা সম্পত্তি পেতো ততটাই পাচ্ছে। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশে এখনো বেশির ভাগ নারীরা বাবার বাড়ির সম্পত্তি আদায় করতে পারে না। কখনো ভাই বা ভাইয়ের ছেলের পেশির জোরের কাছে হার মানতে হয়, কখনো বা সমাজের তৈরি কুসংস্কার রীতির কারণে। সমাজ যতই আপডেট বা হালনাগাদ হচ্ছে না কেন, মানুষ এখনো সম্পত্তি বণ্টন নীতির ক্ষেত্রে নারীদেরকে অবহেলা করেই যাচ্ছে।
অনেকেই আছে, অনেক ধর্ম কর্ম করে কিন্তু নারীদের সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে বেশ উদাসীন। বিশেষ করে বোন আর ফুফুর ক্ষেত্রে। অনেকেই বিভিন্ন চাপে পড়ে দিতে চাইলেও দেখা যায় যে, একদম কম দামী জায়গাটি দেওয়ার মতলব করে। যেমন, বাড়ির ভেতরে বাগান বা আঙিনা যে জমি একজন বোনের প্রয়োজন নেই, কেননা সে থাকবে স্বামীর বাড়ি।
আবার, সবাই যে দিতে চায় না তাও না। অনেক সময় অনেক ভাই বা ভাইয়ের ছেলেরা দিতে চাইলেও বাকি অংশীদারদের চাপে পড়ে চুপ থাকতে বাধ্য হয়। এমন কুসংস্কারও আছে যে, বাবার বাড়ির সম্পত্তি স্বামী বাড়িতে নিয়ে আসলে সেটি কোন না কোন অমঙ্গল বয়ে আনে; ভাবা যায় আজকে দিনে এখনো এমন কথা গ্রামে শুনতে পাওয়া যায়।
যাই হোক, নিজের রক্ত পানি করা সম্পত্তি অনেক বাবা মা চায় তার সন্তানদের মাঝে ধর্ম অনুযায়ী বা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সুষম বণ্টন করতে। তাই, অনেকেই জীবিত অবস্থাতেই নিজের সম্পত্তি হেবা করে দিয়ে যান নিজের ছেলে মেয়েদের মাঝে। আবার, অনেকেই আছে মেয়েকে যাতে না ঠকানো হয়ে থাকে তাই মেয়ের জন্য সামান্য কিছু সম্পত্তি আলাদা করে উইল করে যায়।
কিন্তু, আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে, যদি আপনি জীবিত অবস্থায় আপনার বিবাহিত মেয়ে/ কন্যা মৃত্যু বরণ করেন এবং ঐ মৃত মেয়ে/ কন্যার সন্তান থেকে থাকে, তাহলে সেই সন্তানকে আপনি সম্পত্তি দিতে চাইলে কিভাবে দিবেন। শুরুতেই যেমনটা বলছিলাম যে, লা ওয়ারিশ প্রথা বাতিল হওয়ার কারণে নানা জীবিত অবস্থায় মা মারা গেলে নাতি নাতনিরা মা জীবিত থাকলে যতটা সম্পত্তি পেতো ততটাই পাবে। কিন্তু, যদি মামা বা মামাতো ভাইয়েরা যদি উদার মন মানসিকতার না হয়ে থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে নানা/নানী হিসেবে আপনার আমার দায়িত্ব হচ্ছে, জীবিত অবস্থায় ঐ এতীম নাতি নাতনির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তাদের প্রাপ্য হকটুকু সুনিশ্চিত করে দেওয়া। আর, নাতি নাতনির ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে গিয়ে অতি উৎসাহী হলে চলবে না। এখনো অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। গ্রামে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ‘জ্বলন্ত কড়াই থেকে লাফ দিয়ে জ্বলন্ত চুলোয় পড়া’- অর্থাৎ একটি মাছকে ধরুন জ্বলন্ত কড়াইতে ভাজা (ফ্রাই) করা হচ্ছে, এখন মাছটি কড়াই থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য লাফ দিলো, কিন্তু কড়াই থেকে লাফ দিয়ে মাছ গিয়ে পড়লো জ্বলন্ত চুলার মধ্যে। এবার আপনিই বলুন, মাছটি কোথায় ভালো ছিল? কড়াইতে থাকলে মাছটি ভাজা হতো, মানুষ খেতে পারতো কিন্তু চুলার মধ্যে পড়ার কারণে মাছটির সামান্য মাত্র অস্তিত্ব টিকে থাকবে বলে মনে হয় আপনার?
তেমনি ভাবে, ছেলে বা ছেলের ছেলে তথা নাতির হাত থেকে বাঁচাতে মৃত মেয়ের সন্তানদেরকে যদি আপনি সম্পত্তি হেবা বা দান করে দিয়ে থাকেন, তাহলে সেক্ষেত্রেও এমন একটি ঝুঁকি রয়েছে। যদি আপনার মৃত মেয়ের সন্তানরা নাবালক হয়ে থাকে, তাহলে ঐ নাবালক সন্তানদের যেকোনো সম্পত্তি তাদের বাবা তাদের কোন প্রকার আপত্তি বা অনুমতি ব্যতিরেকেই বিক্রি করে দিতে পারবেন। বিশ্বাস হচ্ছে না?- নিচে ৪ পর্বে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি নিয়ে আলোচনার লিংক দেওয়া হল, ইচ্ছে করলে ঘুরে আসতে পারেন।
নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি: পর্ব ১
নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি: পর্ব ২
নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি: পর্ব ৩
নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি: পর্ব ৪
আপনি আপনার এতীম নাতি নাতনির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে গিয়ে বরং তাদের বাবার হাতেই পুরো সম্পত্তি তুলে দিচ্ছেন কিনা সেটি একাধিকবার ভেবে দেখুন। যদি আপনার মৃত মেয়ের স্বামী ভালো হয়ে থাকে, তাহলে তো সমস্যা নেই। কিন্তু, যদি তিনি পুনরায় বিয়ে করে সৎ মায়ের তালে পড়ে এতীম ছেলে মেয়েদের সাথে নির্মম হয়, তাহলে আর দেখতে হবে না। অন্যদিকে, আপনার মৃত্যুর পর আপনার ছেলে বা ছেলের ছেলে যদি আপনার মৃত মেয়ের ছেলে মেয়েকে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করতে চায়, তখন তার কিন্তু আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে এবং হয়ত আইনি লড়াই করে সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। এবার, আপনিই ঠিক করুন, কোনটি জ্বলন্ত কড়াই আর কোনটি জ্বলন্ত চুলা?
হতাশ হওয়ার কিছু নেই, আছে উপায়; না এই উপায় ইউসিবি ব্যাংকের উপায় নয়। আপনার আমার উচিত বিচক্ষণতার সাথে এমন কিছু করে যাওয়া যাতে এতিম নাতি নাতনি সাবালক হওয়ার পর জানতে পারবে তাদের নামে তাদের নানা/নানী কিছু সম্পত্তি রেখে গেছেন। এজন্য হয় গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে হবে বা বিশ্বস্ত কারো হেফাজতে তাদের জন্য স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি রেখে যাওয়া যেতে পারে। যেমন, অনেকেই গোপনে নাতি নাতনির নামে ব্যাংকে টাকা জমা করে যায়, কিন্তু সেটি তারা সাবালক হওয়ার আগে কাউকে জানানো হয় না। আবার, কখনো এক টুকরো জমি বা কোন ফ্ল্যাট কিনে তাদের নাম দলিল করে সেই দলিল বিশ্বস্ত কারো জিম্মায় রেখে দেওয়া হয় তারা সাবালক হওয়া পর্যন্ত। আরও অনেক উপায় আছে, একটু চিন্তা করে বের করতে পারেন। নয়ত নিজের ছেলে মেয়েদের বলে যাবেন যাতে আপনার এতীম নাতিনাতনির হক নষ্ট না করে, এতে আপনার আত্মা কষ্ট পাবে বা কবরে আজাব হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )