আবির চক্রবর্তী এবং শ্রাবন্তী চক্রবর্তীর কুড়ি বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে, যখন আবির চক্রবর্তী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আবির চক্রবর্তীর মৃত্যুকালে এক ছেলে এক মেয়ে এবং বিধবা শ্রাবন্তী চক্রবর্তীকে রেখে যান। সাথে রেখে যান ঢাকায় বহু দল ভবন বিশিষ্ট একটি ভবন, যার বর্তমান বাজার মূল্য দুই কোটি টাকা। এখন এক্ষেত্রে সম্পত্তি বন্ধন কিভাবে হবে?
সাধারণত আমরা জানি যে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে ৫৩ জনের একটি তালিকা রয়েছে। একজন মৃত ব্যক্তির ৫৩ জন উত্তরাধিকারের ঐ তালিকাতে যারা প্রথমদিকে থাকবে এবং জীবিত থাকবে তাদেরকেই সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দেওয়া হবে। ৫৩ জনের তালিকার প্রথমেই যাকে পাওয়া যাবে তাকে সম্পত্তি দেওয়া হবে। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে, প্রথম চারজন।
প্রথম চারজন একসাথেই সম্পত্তি পেয়ে থাকে, বুঝতেই পারছেন প্রথম চারজন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জি, হ্যাঁ।
প্রথমজনই হচ্ছে পুত্র অর্থাৎ ছেলে।
দ্বিতীয়জন হচ্ছে পৌত্র অর্থাৎ ছেলের ছেলে (নাতি)।
তৃতীয়জন হচ্ছে প্রপৌত্র অর্থাৎ ছেলের ছেলের ছেলে বা ছেলের নাতি বলতে যা বোঝায়।
আর চতুর্থ হচ্ছে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী অর্থাৎ বিধবা। আজকে আমরা আলোচনা করব হিন্দু আইন অনুসারে বিধবা স্ত্রীর উত্তরাধিকার অর্থাৎ আমাদের কল্পিত গল্পের কল্পিত বিধবা শ্রাবন্তী চক্রবর্তী উত্তরাধিকার নিয়ে।
সাধারণত আমাদের সমাজে এটি প্রচলিত আছে যে হিন্দু আইন অনুসারে, নারীরা কখনো সম্পত্তিতে অধিকারী হতে পারে না; এই বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বুঝা উচিত। প্রথমত, কোন সম্পত্তিতে আপনি অধিকারী কিভাবে হতে পারেন?
এই বিষয়টি বুঝতে আগে একটু এদিকে খেলাল করুন, অধিকারী হচ্ছে অনেকটা মালিকানা অর্জন করার মত। যেকোনো ব্যক্তি মালিকানা অর্জন করতে পারে দুইভাবে। প্রথমত, সম্পত্তি ক্রয় করে মালিকানা অর্জন করতে পারে অথবা দ্বিতীয়ত কারো কাছ থেকে সেটি পেয়ে মালিকানা অর্জন করতে পারে।
এখন কারো কাছ থেকে পাওয়াটা হতে পারে আবার বিভিন্ন উপায়ে। বিশেষ করে উত্তরাধিকার আইন অনুসারে তার আত্মীয় কেউ মারা গেলে সেই জায়গা থেকে সে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু পেতে পারে অথবা তার কোন আত্মীয়-স্বজন তাকে সম্পত্তির দান করে দিতে পারে। হিন্দু আইন অনুসারে নারীরা কোন সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে না বলতে যে বিষয়টি বুঝায় সেই বিষয়টি আরেকটু জটিল।
প্রথমত একজন হিন্দু নারী যদি কারো কাছ থেকে কোন সম্পত্তি ক্রয় করে সেক্ষেত্রে সেই সম্পত্তির মালিকানা উনি অর্জন করতে পারেন। ঐ সম্পত্তি নিয়ে উনি যা খুশি তাই করতে পারবে। আপনি আমি যেমন কোন একটি সম্পত্তি ক্রয় করে যা খুশি তাই করতে পারি, একজন হিন্দু নারী একটি সম্পত্তি ক্রয় সূত্রে মালিকানা অর্জন করলে, যা খুশি তাই করতে পারবেন।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে উত্তরাধিকার সূত্রে যখন কোন নারী কোন সম্পত্তি পেয়ে থাকে, হিন্দু আইন অনুসারে সেক্ষেত্রে সেই সম্পত্তিতে তার শুধুমাত্র জীবনস্বত্ব পেয়ে থাকেন। জীবনস্বত্ব বলতে কি বুঝায়?
জীবনস্বত্ব বলতে বুঝায়, আপনি যতদিন জীবিত আছেন ততদিন পর্যন্ত ঐ সম্পত্তি আপনি ভোগ দখল করতে পারবেন। কিন্তু আপনি সেটার মালিকানা অর্জন করতে পারবেন না। খেয়াল রাখতে হবে মালিকানা অর্জন করলে ঐ সম্পত্তির সাথে যা খুশি তাই করা যায়। আপনি চাইলে ওই সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবেন, আপনি চাইলে ওই সম্পত্তি কাউকে হস্তান্তর করতে পারবেন। কিন্তু আপনি যখন জীবনস্বত্ব ভাবে কোন সম্পত্তির দখলে থাকবেন, সেক্ষেত্রে আপনি ওই সম্পত্তি কেবলমাত্র ব্যবহার করতে পারবেন; সেটি কাউকে হস্তান্তর করতে পারবেন না।
সহজ করে বললে অনেকটা এমন যে, আপনি আপনার স্বামী বা পিতার সম্পত্তির লাইফটাইম কেয়ারটেকারের ভূমিকা পালন করবেন। কেননা আপনার মৃত্যুর সাথে সাথেই ওই সম্পত্তি অন্য কোন উত্তরাধিকারের কাছে চলে যাবে। মজার বিষয় হচ্ছে, ঐ উত্তরাধিকাররা কিন্তু আপনার উত্তরাধিকার নয়।
সাধারণত আমরা দেখে থাকি, সম্পত্তির মালিকানা আমাদের কাছে থাকে আমাদের মৃত্যুর পর আমাদেরই উত্তরাধিকারদের কাছে চলে যায়। কিন্তু হিন্দু আইন অনুসারে যারা জীবনস্বত্ব পেয়ে থাকে, তারা সারা জীবন ঐ সম্পত্তি ভোগ দখল করে এবং তাদের মৃত্যুর পর ওই সম্পত্তি কিন্তু তাদের উত্তরাধিকারদের কাছে যায় না। বরং, সে যার সম্পত্তির জীবনস্বত্ব পেয়েছে তার উত্তরাধিকারদের কাছে চলে যাবে।
অর্থাৎ আবির চক্রবর্তীর সম্পত্তিতে তার বিধবা স্ত্রী শ্রাবন্তী চক্রবর্তী যে জীবনস্বত্ব অধিকারটি পাবেন, সেটি শ্রাবন্তী চক্রবর্তীর পুরো জীবনে ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু শ্রাবন্তী চক্রবর্তী মারা যাওয়ার পর ওই সম্পত্তি উনার নিজের(শ্রাবন্তী) যে উত্তরাধিকার আছে, তাদের কাছে কিন্তু যাবে না; যাবে হচ্ছে আবির চক্রবর্তী উত্তরাধিকারদের কাছে। আশা করি এতোটুকু বুঝতে পেরেছেন।
হিন্দু বিধবা স্ত্রীর যদি ছেলে না থাকে কিংবা সন্তান না থাকে সেক্ষেত্রে খুবই করুন অবস্থা হয়ে থাকে। ছেলে সন্তানরা থাকলে তারা মালিকানা অর্জন করে এবং বিধবা মাকে দেখে শুনে রাখতে পারে। অন্যথায় বিধবা নারী যেহেতু স্বামীর সম্পত্তিতে জীবনস্বত্ব ভোগ করে, সেক্ষেত্রে বিধবার স্বামীর যেসব পুরুষ উত্তরাধিকার রয়েছে, তারা সারা জীবন ওই বিধবা নারীর মৃত্যু কামনা করে বসে থাকে। কারণ ঐ বিধবা নারী যখনই মারা যাবে তখনই ওই সম্পত্তি তার স্বামীর জীবিত যে পুরুষ উত্তরাধিকার রয়েছে তাদের কাছে চলে যাবে।
যার ফলে বাকিদের কাছে একরকম শত্রুতে পরিণত হয়ে থাকে বিধবা স্ত্রী। যদিও এখন কিছু কেস রেফারেন্সে দেখা যাচ্ছে, আদালতের অনুমতি নিয়ে বিধবা নারী কিছু সম্পত্তি বিক্রি করতে পারছে। কিন্তু আইনত সরাসরি পূর্ণ অধিকার না দেওয়া পর্যন্ত পুরুষ উত্তরাধিকাররা তার সাথে কটু সম্পর্ক বজায় রাখবে।
এমনও শুনতে পাওয়া যায় যে, হিন্দু বিধবা আদালতের অনুমতি নিয়ে সম্পত্তি বিক্রি করছে সেক্ষেত্রে প্রচুর বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সম্পত্তি ক্রেতা ঠিক মত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ক্রেতা পেলেও ভালো মূল্য পাওয়া যাচ্ছে, কারণ দখল নিয়ে সমস্যা তো থেকেই যাচ্ছে। কে চায় টাকা দিয়ে জমি কিনে ফ্রিতে শত্রু প্রতিবেশী কিনতে?
একজন পুরুষ মানুষটা সারা জীবনের কষ্টের দিতে টাকা দিয়ে যে সম্পত্তি অর্জন করছে বা পৈত্রিক ভাবে যে সম্পত্তি পাচ্ছে বা একজন স্ত্রীর সাথে সারা জীবন সংসার করে স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে বা স্ত্রীর শ্রম/অর্থ দিয়ে যে সম্পত্তি তৈরি করেছে, সেই সম্পত্তিতে যদি ওই স্ত্রী যখন বিধবা হচ্ছে তার শুধু জীবনস্বত্ব অধিকার থাকে, সেটি আসলেই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মেনে নিতে কষ্ট হয়। আইনটি সংশোধন করে হিন্দু বিধবা নারীদেরকে সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার অর্থাৎ মালিকানা দেওয়ার অধিকার দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )