One signature on the document can be a lifelong regret

দলিলে একটি স্বাক্ষর হতে পারে সারা জীবনের আফসোস

উত্তরাধিকার আইন

আজ থেকে কয়েক বছর পূর্বে আমার মামার আমন্ত্রণে আমার মা এবং খালাকে আমাদের নানা বাড়ি যেতে হয়। ব্যস্ততার কারণে আমার বাবা যেতে পারেননি। আমি ছোট ছিলাম আমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। আমার নানা জীবিত অবস্থায় সকল সম্পত্তি নিজের স্ত্রীর নামে লিখে দিয়েছিল। যার ফলে নানার মৃত্যুকালে নানার নামে কোন সম্পত্তি ছিল না। সকল সম্পত্তি আমার নানুর নামে ছিল। নানুর অসুস্থতার কথা বলে আমার মা এবং আমার খালাকে মামা নানা বাড়িতে আমন্ত্রণ করেছিল এবং সেই আমন্ত্রণে গিয়ে জানা গেল যে, আমার নানু একটি উইল করতে যাচ্ছে।
উইল অনুযায়ী উনার মৃত্যুর পরে সকল সম্পত্তিতে ওনার ছেলে মেয়েরা সমান ভাবে অধিকারি হবে। আমার মা এবং খালা উভয়েই অশিক্ষিত ছিল। যার ফলে কিছু না বুঝেই ওই দলিলে সই করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায় যে, ওই দলিলে আমার নানু তার সমুদয় সকল সম্পত্তি আমার মামার নামে লিখে দিয়েছিল এবং সাক্ষী হিসেবে আমার মা এবং খালাকে রেখেছিল। তার কিছুদিন পরে আমার নানু মারা যায় এবং সকল সম্পত্তি মামা নিজের নামে জমা খারিজ করিয়ে নেয়।
মা এবং খালা অনেক দূরে স্বামীর বাড়িতে থাকার ফলে নিজের বাবার বাড়িতে তেমন যাওয়া আসা করা হতো না। এদিকে মা এবং খালা উভয়ের স্বামীর বাড়িতে আর্থিক অবস্থা ভালো বিধায় বাবার বাড়ি থেকে কিছু আনার প্রয়োজনও বোধ করেননি। যার ফলে নানুর সকল সম্পত্তি এক মামা একাই ভোগদখল করতে থাকেন। এক সময়ে যখন মামা মৃত্যুবরণ করেন তখন মামাতো ভাই বোনদের এক কথায় দুই কথায় আমরা জানতে পারি যে, সকল সম্পত্তি মামার নামে রয়েছে। আমার মা খালার নামে কোনও সম্পত্তি নেই।
পরবর্তীতে আমরা যখন ঐ দলিল দেখতে পাই এবং দলিলে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে আমার নানু তার সকল সম্পত্তি আমার মামাকে লিখে দিয়েছে এবং ওই দলিলের দুইজন সাক্ষী হিসেবে আমার মা এবং আমার খালা স্বাক্ষর করেছেন। এমতাবস্থায় নানার বাড়িতে মা এবং খালা যে প্রতারণার শিকার হলো, সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?

উপরে উল্লেখিত ঘটনাটি কাল্পনিক। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। খোঁজ খবর নিলে এখনও আনাচে কানাচে অনেক জায়গায় এই ধরনের ঘটনার কথা শুনতে পাওয়া যায়। পারিবারিক ভাবে বা অন্য যেকোনো ভাবে ভুল বুঝিয়ে বাবা মায়ের কাছ থেকে সন্তানরা তাদের সম্পত্তি লিখিয়ে নিচ্ছে, ভাই বোনদের ঠকাচ্ছে। আর স্বাভাবিকভাবেই নিজের পারিবারিক বিষয় বাহিরে কাউকে জানাজানি করতে চায় না বলে পরিবারের মধ্যে বিষ খেয়ে বিষ হজম করতে হয়। এক্ষেত্রে সবসময় যে বাবা মায়েরা বুঝেশুঝে এই ধরনের কাজ করা হয়ে থাকে তা কিন্তু নয়। কখনও কখনও বাবা মা কোন একজন সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসা বেশি থাকার কারণে তারা অন্য সন্তানদেরকে বঞ্চিত করে থাকেন। যার ফলে দেখা যায়, পরিবারের কোন একজন ব্যক্তির অবদান বেশি থাকা সত্ত্বেও যার প্রতি বাবা মায়ের ভালোবাসা বেশি, সে সম্পত্তি বেশি পাচ্ছে। যেখানে সম্পত্তি পাওয়ার কথা সবাই তার নিজ নিজ অংশ অনুযায়ী, সেখানে বাবা মায়ের এই যে একচেটিয়া অধিকার বলবৎ করার বা কার্যকর করার প্রবণতা তাতে কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অথচ মুসলিম উত্তরাধিকারের যে আইনটি রয়েছে সেখানে যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবেই বণ্টন করা উচিত। আপনি মৃত্যুর পর আপনার সম্পত্তি কিভাবে বণ্টন হবে সেটি মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু আপনি জীবিত অবস্থায় যদি সম্পত্তি বণ্টন করতে চান, সেক্ষেত্রেও আপনি এই আইনটি মেনে চলা উচিত। তবে জীবিত অবস্থায় যাকে যতটুকু খুশী ততটুকু দেওয়া যায়। কিন্তু, এমন কিছু করা উচিত না যে, সন্তানদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং ভারসাম্য বজায় রাখার পথে আপনার মনের ইচ্ছা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এই আইনটি আপনাকে বিবেক খরচ করে এবং আইন মেনে চলা উচিত।

আপনি জীবিত অবস্থায় সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে আরও বেশি ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন। আপনি জানেন আপনি কোন সন্তানের পিছনে খরচ বেশি করেছেন, কোন সন্তানের পিছনে খরচ করেননি। যেমন আমাদের সমাজে দেখা যায় যে আর্থিক অবস্থার কারণে কোন কোন সন্তানের পড়াশোনার পিছনে অনেক বেশি খরচ করা হয়। কোন কোন সন্তানের পেছনে তেমন খরচ করার সামর্থ্য থাকে না। আবার, কোন কোন মেয়ের বিয়েতে অনেক বেশি খরচ করে, অনেক বেশি স্বর্ণ অলঙ্কার দিয়ে অনুষ্ঠান করা হয় কিন্তু কোন মেয়ের ক্ষেত্রে হয়তো তেমন কিছুই করা হয় না। সেক্ষেত্রে আপনার উচিত হচ্ছে, যার পিছনে খরচ বেশি করেছেন তাকে সম্পত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা কমিয়ে বা কম মূল্যবান সম্পত্তি প্রদান করা এবং যার পিছনে কম খরচ করা হয়েছে তাকে বেশী বা মূল্যবান সম্পদ দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া।

বাবা মা জীবিত অবস্থায় সম্পত্তি প্রদান করে গেলে বা বণ্টন করে গেলে ভবিষ্যতে সেটি নিয়ে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কেননা যার সম্পত্তি, তিনি নিজে যখন বণ্টন করে যায় তখন সেটা নিয়ে কারো তেমন কোন আপত্তি তোলার সুযোগ থাকে না। তবে নিজে বণ্টন করে দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি অনেক বেশি অনিয়ম ভারসাম্যহীনতা থাকে, সেক্ষেত্রে সেটি সারা জীবনের জন্য সন্তানদের মধ্যে একটি বিরোধ লেগেই থাকে এবং সেটি পিতামাতার প্রতি অভক্তি, অশ্রদ্ধার কারণ হয়ে থাকে।

পারিবারিক ভাবে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে তাই আমাদের সব সময় সচেতন থাকা উচিত। উপরে উল্লেখিত যে, কাল্পনিক ঘটনাটি বলা হয়েছে, এমন ঘটনা আমাদের সমাজে এখনো ঘটে থাকে। বাবা মায়ের অসুস্থতার কথা বলে সবাই একসাথে হয়ে যেকোনো একটি দলিলে সকলের স্বাক্ষর নিয়ে পরবর্তীতে রেজিস্ট্রেশন করে যে কোনো এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই আমাদের উচিত হচ্ছে যে কোনো পরিস্থিতিতে কোনো দলিলে স্বাক্ষর করার আগে সেটি আপনি সাক্ষী হিসেবে হোক বা দাতা কিংবা গ্রহীতা হিসেবে হোক, আগে দলিলটি ভালো ভাবে পড়ে নেবেন। এখনকার যুগে আর হাতে লেখা দলিলের তেমন প্রচলন দেখা যায় না। সবক্ষেত্রেই কম্পিউটার কম্পোজ করা থাকে। সেক্ষেত্রে নিজে পরতে পারেন বা দলিল পড়তে পারে এমন কাউকে দিয়ে দলিলটি পড়াবেন, তারপরেই স্বাক্ষর করবেন।

যানবাহনের পিছনে নিশ্চয়ই পড়েছেন, একটি দুর্ঘটনার সারা জীবনের কান্না; ঠিক তেমনি না পড়ে দলিলের একটি স্বাক্ষর হতে পারে আপনার সারা জীবনের আফসোস। উপরের কাল্পনিক ঘটনা যেহেতু মা খালা দু’জনকে দিয়েই অর্থাৎ দুই বোনকে সাক্ষী রেখেই ভাই যখন মায়ের কাছ থেকে সম্পত্তি ক্রয় করে নিয়েছে বা দান গ্রহণ করে নিয়েছে সেক্ষেত্রে মা খালার চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না যে এই দলিল সম্বন্ধে তারা কিছু জানত না। তাছাড়া আমাদের সমাজে এখনো আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ এতোটুকু রয়েছে যে, আমরা চাইলে ভাইবোনদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে লোক হাসাহাসি করতে চাই না। তাই যা করার আগেই করা হয়েছে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.