দিনে সূর্যের আলো আর রাতে চাঁদের আলো, এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক। দিনে চাঁদের আলো যেমন বেমানান, তেমনি রাতে সূর্যের আলোও অস্বস্তিকর। আইনেও তেমনি যে যেমন আছে, তাকে তেমন রাখতেই আইন সমর্থন করে থাকে। যার ফলে কোন অসঙ্গতি দেখা দেওয়ার আগ পর্যন্ত যে যেমন আছে, সে তেমনই থাকুক; এটাই আইনের মূল উদ্দেশ্যে। যেমন, যিনি দখলে আছেন, তিনিই দখলে থাকবেন; এটাই সাধারণ নীতি। যার দখল আছে তাকে যদি শক্তির জোরে বেদখল করার ব্যাপারে আইন সমর্থন করতো তবে প্রত্যেকেই বল প্রয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ত যার ফলশ্রুতিতে সমাজে সৃষ্টি হতো বিশৃঙ্খলা। তাই একটি সমস্যা সমাধানে আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি হোক বা অবৈধ বলপ্রয়োগকে নিরুৎসাহিত করার জন্য এই আইন করা হয়েছে। যার দখল নেই কিন্তু স্বত্ব আছে, সে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবে না। শক্তির জোরে দখলদার ব্যক্তিকে জমির দখলচ্যুত করা যাবে না। তবে স্বত্ববান ব্যক্তি দখল উদ্ধারের মামলা করে জমির দখল পেতে পারেন। যার দখল আছে কিন্তু স্বত্ব নেই সে স্বত্ববান ব্যক্তির বেআইনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে তার দখল বজায় রাখার জন্য আইনি সহায়তা পাবেন। স্বত্ববান ব্যক্তি প্রয়োজনে দখল পুনরুদ্ধারের মামলা করে জবর দখলদারকে বিতাড়িত বা দখলচ্যুত করতে পারে।
জমির মালিকানা থাকে দুইভাবে। এক কাগজপত্র(দলিল, খতিয়ান ইত্যাদি), দুই, দখল। জমি আপনার কিন্তু দখল অন্য কারো; এই সমস্যাটা আমাদের সমাজে অহরহ। শুনতে একটু সস্তা শোনালেও বুঝতে সবচেয়ে সহজ হবে যদি বলি, কাবিননামা অনুসারে স্ত্রী আপনার; কিন্তু আপনার স্ত্রী থাকে পরকীয়া প্রেমিকের কাছে। এটাই হচ্ছে, সবচেয়ে যুগোপযোগী উদাহরণ। আরেকটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে চলুন বিষয়টির মর্ম বুঝার চেষ্টা করি। ধরুন, মোস্তাফিজ সাহেব ঢাকায় চাকরি করেন। তার নোয়াখালীতে একটা বাড়ি আছে । সেই বাড়িতে কালামকে কেয়ারটেকার হিসেবে থাকার জন্য সুযোগ দিলেন। এখন মোস্তাফিজ সাহেব চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। গ্রামে এসে থাকতে চান। কিন্তু, কালাম নিজেকে কেয়ারটেকার দাবি না করে মালিক সাঁজতে চায় এবং এলাকার কিছু মাতব্বর এবং মাস্তানকে টাকা পয়সা দিয়ে দখল ছাড়তে নারাজ। এখন, মোস্তাফিজ সাহেব কালামকে গায়ের জোরে বাড়ি হতে বের করে দিতে পারবেন না। স্বেচ্ছায় না যেতে চাইলে মোস্তাফিজ সাহেবকে দেওয়ানি আদালতে মামলা করে কালামকে বেদখল করতে হবে। যদি জোর করে বের করে দেন তবে কালাম দেওয়ানি আদালতে মামলা করে তার দখল বজায় রাখতে পারবে। কারণ আমাদের দেশে এখনো এসব কেয়ারটেকার নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ডিড ডকুমেন্টস তৈরি করা হয় না। যার ফলে, মোস্তাফিজ সাহেব যে কালামকে নিজে নিয়োগ দিয়েছেন ঐ বাড়ি দেখাশুনা করার জন্য, সেটা প্রমাণ করা মুশকিল হয়ে যায়। অন্য দিকে, কালামের জন্য বেশ সুবিধা হয়ে পড়ে তার দখল সম্বন্ধে আদালত বা প্রশাসনকে সন্তুষ্ট করতে। কেননা, প্রশাসন যখন এসে চারপাশে খোঁজ খবর নিবে তখন কালামের দখলের বিষয়টি সত্য হিসেবে প্রমাণিত হবে। যার ফলে, মোস্তাফিজ সাহেবের মতো লোকেরা তেমন কোন সুবিধা করতে পারেন না।
এই সমস্যা নিরসনে, ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় এই সমস্যার সমাধান সম্বন্ধে বিধান রাখা হয়েছে। এখানে দখলকারীর স্বত্ব বিবাদীর স্বত্বের চেয়ে ভাল বা বিবাদীর কোন স্বত্ব আছে কি না তা দেখার কোন দরকার হয় না। এখানে আদালত স্বত্বের বিষয় বিবেচনা করেন না। শুধু মাত্র দখলের বিষয় বিবেচনা করেন। বেদখল করা হয়েছে কি না তাও বিবেচনা করেন । জমির মালিক না হয়েও মালিকের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে দখলচ্যুত করার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। আপাত দৃষ্টিতে অনেকেই এটা ভাবতে পারেন বা অবজ্ঞা স্বরূপ বলতে পারেন যে, বাংলাদেশের আইন তো উদ্ভট ধরনের আইন। কিন্তু মানুষ যাতে একটা বেআইনি কাজ নিরসন করতে গিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে গিয়ে সমাজে আরও বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে, তাই এই আইনে এই ধরনের বিধান রাখা হয়েছে। আরও উল্লেখ্য, এই আইন শুধু মাত্র বাংলাদেশে নয়, বরং পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই এই আইন প্রচলিত।
আর আপাত দৃষ্টিতে আইন তো কাগজপত্র বিবেচনা না করে হুট করেই কাউকে জমি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই, কাগজপত্র বিবেচনা করতে যে সময় অতিবাহিত হয়, সেই সময় পর্যন্ত যিনি দখলে আছেন, তিনিই যেন শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে পারেন। আইনের দৃষ্টিতে যিনি দখলে আছেন, তাকেই প্রথমে আইনত দখলের অধিকারী বলে মনে করা হয়। স্বত্বের অধিকারী হলে দেওয়ানি আদালতে উচ্ছেদের মামলা করে বেদখল করতে কোন অসুবিধা হয় না। বেদখল হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে এই মামলা দায়ের করতে হয়। এই সময় পার হয়ে গেলে তামাদির কারণে মামলা করা যায় না। মামলা করলেও তা তামাদির কারণে খারিজ হয়ে যাবে। তবে কেউ যদি যথোপযুক্ত কারণ দেখিয়ে আদালতকে মামলা দায়েরের বিলম্ব সম্বন্ধে সন্তুষ্ট করতে পারে, তখন আদালত চাইলে মামলা আমলে নিতে পারেন। কোন কোন ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের তামাদি মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর মামলা করলে মামলা খারিজ হবে না, সেটি নিয়ে অন্য একটি আর্টিকেলে পরিপূর্ণ ভাবে আলোচনা করবো।
দেওয়ানী মামলা ছাড়াও রয়েছে ফৌজদারি প্রতিকার। যদি আপনার অনুমতি ছাড়া কেউ আপনার জমি দখল করে নেয়, তবে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা করতে পারেন। ঘর-বাড়ির জমি হলে দণ্ডবিধির ৪৪৮ এবং অন্য জমি হলে ৪৪৭ ধারায় মামলা করতে হয়। এই মামলায় বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর জেল জরিমানা হতে পারে। এছাড়া প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় মামলা করা যায়। এমনকি বেআইনিভাবে বেদখল করার জন্য দখল ফিরে পাওয়ার সাথে ক্ষতিপূরণের জন্যও মামলা করা যায়।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )