আপনি একজনের কাছ থেকে একটি জমি ক্রয় করেছেন। নগদ অর্থ পরিশোধ করে সাফ কবলা দলিল মূলে আপনি জমিটির মালিকানা অর্জন করলেন। কিন্তু কয়েকদিন পর আপনি যখন ঐ জমিটির নামজারী করাতে গেলেন তখন দেখলেন যে, বিক্রেতা আপনার কাছে যে পরিমাণ জমি বিক্রি করেছেন, তিনি ততটুকুর মালিক নন। আসলে বিক্রেতা মালিক ছিল, কিন্তু আপনার কাছে বিক্রির আগেই তিনি কিছু অংশ আরেকজনের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন যার ফলে আপনার কাছে যতটুকু বিক্রি করেছে, ততটুকু আপনি নিজ নামে নামজারী করাতে পারবেন না। তার মানে যেটা দাঁড়ায়, সেটা হলো দলিল অনুসারে আপনি পুরো সম্পত্তির মালিকানা পাচ্ছেন না। কিন্তু আপনি তো পুরো সম্পত্তির মূল্য পরিশোধ করেছেন। এখন যদি বিক্রেতার এই প্রতারণার সমাধান হিসেবে বিক্রেতা আপনার বাকী টাকা ফেরত দেয়, তাহলে বিক্রেতা চাইবে দলিল সংশোধন করিয়ে নিতে। বাকী টাকা ফেরত দিতে না চাইলে আপনিও মামলা করতে পারবেন বাকী অর্থ আদায়ের জন্য।
এই যে বিক্রেতা আপনার সাথে প্রতারণা করলো, যার ফলে আপনার দলিলটি সংশোধন করা লাগতেছে, একই ভাবে যদি প্রতারণা ছাড়াই শুধুমাত্র পক্ষসমূহের পারস্পরিক ভুলের কারণে দলিলের কোন বিষয়বস্তু সঠিক না থাকে বা দলিলের মধ্যে পক্ষদ্বয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রকাশে ব্যর্থ হয়, তাহলে চাইলে আপনি আপনার দলিলটি সংশোধন করাতে পারবেন।
আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, বিক্রেতা হিসেবেও আপনি প্রতারিত হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ ধরে নিন, আপনি আপনার একটি বড় জমির মধ্য থেকে একটি অংশ বিক্রি করলেন, যেখানে আপনি বিক্রিত জমির চৌহদ্দী বা সীমানা যেটি নির্ধারণ করেছেন, ক্রেতা প্রতারণা করে দলিল লেখককে দিয়ে চৌহদ্দী পরিবর্তন করিয়ে ফেললেন। আমরা জানি রাস্তার পাশের জমির মূল্য ভেতরের জমি অপেক্ষা একটু বেশী। এখন আপনি বিক্রি করছেন রাস্তা থেকে একটু ভেতরের জমি, কিন্তু ক্রেতা প্রতারণামূলক ভাবে দলিল করে নিয়ে নিলো রাস্তার পাশের জমিটি। যেহেতু একই খতিয়ান এবং দাগভুক্ত তাই আপনি শুধু চৌহদ্দীর মারপ্যাঁচটা ধরতে পারলেন না। কিন্তু, পরক্ষনে যখন আপনি দখল বুঝিয়ে দিতে গেলেন, তখনি ক্রেতা দাবি করলো রাস্তার পাশের জমি। আর, তখনি আপনি বিক্রেতা হিসেবে বুঝতে পারলেন যে, আপনি প্রতারিত হয়েছেন। তখন আপনি চাইলে (অবশ্যই আপনি বা আপনার উত্তরাধিকাররা বা প্রতিনিধিরা চাইবে) দলিল সংশোধনের মামলা করে দলিলের এই ভুলটি সংশোধন করতে পারবেন।
কখনো কখনো দলিল এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যে, দলিলের সংশোধন যথেষ্ট নয়, আস্ত দলিলই বাতিল করার প্রয়োজন পড়ে। যেমন, জাল দলিল। এই দলিল সংশোধন করে কোন লাভ নেই। তাই ঐ দলিল বাদ দেওয়াই আবশ্যক। দলিল বাতিলের বিষয় নিয়ে আমরা আরেকটি অনুচ্ছেদ প্রকাশ করেছি, যা আপনি দলিল বাতিল – কি, কেন, কিভাবে? এই আর্টিকেলে দেখতে পারেন। এখানে শুধুমাত্র দলিল সংশোধনে নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।
এবার আসুন আমরা জানার চেষ্টা করি, কে বা কারা দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করতে পারবেন। দলিল সংশোধনের মামলা করতে হলে আপনাকে অবশ্যই দলিলের পক্ষ হতে হবে বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বৈধ প্রতিনিধি হতে হবে। কোন প্রকার সংশ্লিষ্টটা না থাকলে আপনি একটি দলিল সংশোধনের মামলা করতে পারবেন না। বাদী হিসেবে আপনাকে দলিলের পক্ষ বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বৈধ প্রতিনিধি হতে হবে।
দেওয়ানী মামলায় সবসময় তামাদি মেয়াদ খেয়াল রাখতে হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের না করলে মামলাটি খারিজ হয়ে যাবে। তাই দলিল সংশোধন সম্বন্ধে তো জানলেন, কিন্তু তামাদি মেয়াদ না জানলে, সঠিক সময়ের মধ্যে মামলা না করলে দলিলের ভুলটিই হজম করতে হবে। তামাদি আইন ১৯০৮ এর ৯৫ এবং ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে, দলিল সংশোধনের তামাদি মেয়াদ হচ্ছে, ৩ বছর। তবে এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে, যে দিন হতে বাদী অর্থাৎ আপনি আপনার দলিলের ভুল বা প্রতারণা বা প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রকাশের ব্যর্থতা সম্বন্ধে জানতে পারবেন, সেই দিন থেকে ৩ বছরের মধ্যে দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করতে পারবেন।
সর্বোপরি, দলিল সংশোধনের এই বিধানটি দেওয়া হয়েছে, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারায়। যদিও ৩১ ধারায়, এই দলিলের পরিধি অনেক বড় করে দেখানো হয়েছে। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, A contract or other instrument in writing, অর্থাৎ, একটি লিখিত চুক্তি বা অন্য কোন লিখিত দলিলকে সংশোধন করার জন্য ৩১ ধারার ব্যবহার করা যেতে পারে।
এবার আসুন মজার ঘটনায়। ধরুন, একটি জমির পরিমাণ ১০ শতক, আমি ঐ জমির মালিক থাকাবস্থায় ঐ জমি থেকে ৫ শতক একজনের কাছে বিক্রি করলাম। কিন্তু, ক্রেতা প্রতারণা করে এই জমির দলিলে ১০ শতক লিখিয়ে নিয়ে তা তড়িঘড়ি করে আপনার কাছে বিক্রি করে দিল। আপনি ঐ লোকের প্রতারণার কথা জানতেন না। এদিকে আমি ঐ দলিল সংশোধনের জন্য আদালতে মামলা করে দিলাম। আমিও ন্যায়ের পথে আছি, আপনিও সরল বিশ্বাসে এবং টাকার বিনিময়ে জমি ক্রয় করেছেন। এখন এই দলিল সংশোধন হলে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আবার সংশোধন না হলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যেহেতু, দলিল সংশোধনের আদেশ দেওয়া না দেওয়া হচ্ছে, আদালতের বিবেচনা মূলক ক্ষমতা; তাই আদালত আপনি অর্থাৎ সরল বিশ্বাসে এবং মূল্যের বিনিময়ে ক্রয় করা তৃতীয় পক্ষের কখনো অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোন আদেশ দিবেন না। আদালত বিবেচনা করেই ন্যায় বিচার (Justice ensure) প্রতিষ্ঠা করবেন।
নিচে ছকের মাধ্যমে এক নজরে দলিল সংশোধনের খুঁটিনাটি তুলে ধরা হল:
কি কি সংশোধন করা যায় এবং কোন আইনের অধীনে? | সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা মতে কোন লিখিত চুক্তি বা অন্য কোন লিখিত দলিল। |
কি কি শর্তে সংশোধন করা যায় ? | ১। দলিলের কোন পক্ষের প্রতারণা,
২। পক্ষসমূহের পারস্পরিক ভুল, ৩। দলিলে পক্ষসমূহের সত্যিকার উদ্দেশ্য প্রকাশে ব্যর্থতা |
কে কে মামলা করতে পারবে? | ১। দলিলের যে কোন পক্ষ,
২। দলিলের পক্ষসমূহের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বৈধ প্রতিনিধি। |
তামাদি মেয়াদ | তামাদি আইনের ১৯০৮ এর অনুচ্ছেদ ৯৫ এবং ৯৬ অনুযায়ী ৩ বছর। |
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )