বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাদেরকে অনেক সময় আমাদের জমির মাপ বা জরীপ করতে হয়। এই মাপ বা জরীপের কাজ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে করা হলেও সবচেয়ে বেশি যেসব কাজে করা হয়ে থাকে, সেগুলো হচ্ছে,
জমি ক্রয়ের পূর্বে জমির পরিমাণ জানতে
জমি ক্রয়ের পূর্বে জমির পরিমাণ ঠিক আছে কিনা সেটি যাচাই করার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই জমির মাপ বা জরীপ করা উচিত। এতে দলিলে বা খতিয়ানে জমির যে পরিমাপ দেওয়া আছে, সেটি সরেজমিনে রয়েছে কিনা তা যাচাই করার জন্য একজন সার্ভেয়ার বা আমীন দিয়ে জমি মেপে দেখা উত্তম।
জমিতে বাড়ি করার জন্য
জমিতে বাড়ি বা ইমারত করার জন্য জমির একটি পরিমাপ জানা জরুরী, এতে বাড়ির নকশা থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের অনুমতি নেওয়া সবকিছুর জন্যই জমির সঠিক মাপ আবশ্যক। এর জন্য একজন সার্ভেয়ার বা আমীন দিয়ে জমি মেপে নিতে হবে।
জমি বর্গা দেওয়া
গ্রামগঞ্জে জমি বর্গা দেওয়ার বেশ প্রচলন রয়েছে। বর্গা দেওয়ার আগে জমির মালিক বেশি মুনাফার জন্য জমির পরিমাণ যেমন বেশি বলে থাকেন, তেমনি বর্গা চাষি কম টাকা বা ফসল দেওয়ার আশায় জমির পরিমাণ কম বলে থাকেন। এই বিরোধ বা দ্বন্দ্ব দূর করার জন্য আমাদের জমির সঠিক পরিমাপটি বের করতে হয়।
জমিতে পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে
গ্রাম অঞ্চলে গভীর নলকূপের যারা ব্যবসা করেন এবং চাষের মৌসুমে কৃষি জমিতে পানি দিয়ে থাকেন তাদেরকে কৃষকের জমির পরিমাণ জানতে হয়। জমির বিঘা বা শতক অনুসারে সাধারণত পানি দেওয়া হয় এবং বিঘা বা শতক অনুসারেই টাকা নেওয়া হয়। তখন কৃষক চাইবেই জমির পরিমাণ কম বলতে আর গভীর নলকূপের মালিক চাইবে জমির পরিমাণ বেশি বলে বেশি টাকা নিতে। এই বিরোধ বা দ্বন্দ্ব দূর করার জন্য কৃষকের জমির সঠিক পরিমাপটি জানা আবশ্যক।
জমিতে চাষ দেওয়ার ক্ষেত্রে
কৃষি জমিতে এক সময় গরু মহিষ দিয়ে হাল চাষ হতো, যা বর্তমানে ট্রাকটার দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। এখন পানি দেওয়ার মত চাষও দেওয়া হয় জমির বিঘা বা শতক অনুসারে এবং বিঘা বা শতক অনুসারেই টাকা নেওয়া হয়। তখন কৃষক চাইবেই জমির পরিমাণ কম বলতে আর ট্রাকটার মালিক চাইবে জমির পরিমাণ বেশি দেখাতে। এই বিরোধ বা দ্বন্দ্ব দূর করার জন্যও কৃষকের জমির সঠিক পরিমাপটি জানা আবশ্যক।
এজমালি সম্পত্তিতে ভোগদখল
এজমালি সম্পত্তিতে সাধারণত একের অধিক মালিক থাকে যারা কিনা এক সাথে এজমালি সম্পত্তি ভোগদখল করে থাকে। এখন এজমালি সম্পত্তির ভোগদখল নিয়েও প্রায় দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। যেমন ধরুন, একটি বাগান এজমালি সম্পত্তি, সে সম্পত্তিতে কাঠ, ফল, পাতা, মাটি ইত্যাদি কে কতটুকু ভোগ করবে, সেটি নিয়ে প্রায় দ্বন্দ্ব লেগে যায়। এক ফুট জায়গা নিয়ে মারামারি পর্যন্ত হয়ে যায়। গ্রাম অঞ্চলে বিশেষ করে বাঁশ বাগান আর পুকুরের পাড় নিয়ে বেশি ঝগড়া হয়। এখন, এজমালি সম্পত্তিতে কার সীমানা কতটুকু এটি নিশ্চিত করতেও মাপ বা জরীপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
উপরের এই কয়টি কারন ছাড়াও আরও অনেক কারনে জরীপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সবসময় জরীপ সার্ভেয়ার বা আমীন দিয়ে মাপলে সঠিক ফলাফল পাওয়া গেলেও দেখা যায় যে, আমরা যদি সার্ভেয়ার বা আমীন ডেকে মাপ দিতে যাই, তখন দেখা গেছে কয়েক হাজার টাকা পারিশ্রমিক দিতে হয়। যখন জমিতে অন্যজনের সাথে পরিমাপগত দিক থেকে দ্বন্দ্ব থাকে সেই ক্ষেত্রে সার্ভেয়ার বা আমীন ডেকে পরিমাপ করা উত্তম।
কিন্তু শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত বা আন অফিসিয়াল কোন তথ্য জানার জন্য জমির পরিমাপ করা হয় সেক্ষেত্রে নিজে নিজে জমি পরিমাপ করতে পারলে সার্ভেয়ার বা আমীনের খরচটি যেমন লাগে না তেমনি নিজের জমির প্রতি নিজেরও একটি ভালো ধারনা জন্মায়। দিন শেষে নিজের সম্পত্তির হিসেব নিকেশ নিজের নখদর্পণে থাকাই উত্তম।
কারো যদি গ্রাম অঞ্চলে ছোট একটি ৫ শতাংশের জমি থেকে থাকে বা তিন কাঠার একটা জমি থেকে থাকে সেই জমিটির পরিমাপের জন্য সার্ভেয়ার বা আমীন ডেকে মাপ দিতে গেলে সার্ভেয়ারকে কয়েক হাজার টাকা দেওয়া এবং খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয় বলে অনেক সময় সেটি অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। তাই নিজের জমি নিজে পরিমাপ করার সামান্য ধারণা থাকলে নিজে নিজেই মেপে নিতে পারেন।
জমি ক্রয় বিক্রয় বা ইমারত প্রতিষ্ঠা ব্যতীত উপরে উল্লেখিত কারণগুলোর জন্য সার্ভেয়ারকে ডেকে এনে জমি মাপ করতে গেলে সেটি ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ হয়ে যায় বলে অনেকের ধারনা। তাই আজকে আমরা জানার চেষ্টা করবো,সহজে কিভাবে নিজের জমি নিজে পরিমাপ করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে নিজের জমি নিজে পরিমাপ করার জন্য সবচেয়ে সহজ যে উপায়টি হচ্ছে সেটি হচ্ছে দূরত্ব পরিমাপ করার ফিতা। ফিতার মাধ্যমে সহজেই জমির দৈর্ঘ্য প্রস্থ বের করার মাধ্যমে জমির ক্ষেত্রফল বা পরিমাপ বের করা সম্ভব।
সাধারণত আমাদের দেশে বেশিরভাগ জমি চতুর্ভুজ প্রকৃতির হয়ে থাকে, যেসব জমিতে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চার দিক থাকে। আপনাকে ফিতা দিয়ে মেপে প্রথমে জমির চারটি বাহু বের করতে হবে। চারটি বাহু হচ্ছে,
- উত্তর বাহু
- দক্ষিণ বাহু
- পূর্ব বাহু
- পশ্চিম বাহু।
চারটি বাহু কোনটি কত ফুট সেটি একটি কাগজে নোট রাখবেন। এবার উপরের চিত্রের মত জমির একটি নকশা আকবেন। জাস্ট একটি বক্সের মত, তারপর কোন বাহু কত ফুট সেটি ঐ বাহুর পাশে লিখবেন।
চারটি বাহুর দৈর্ঘ্য বের করার পর আপনাকে উত্তর বাহু এবং দক্ষিণ বাহু যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ দিতে হবে। আবার পূর্ব বাহু এবং পশ্চিম বাহু যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ দিতে হবে। ধরে নিলাম উত্তর বাহু এবং দক্ষিণ বাহু যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ দিয়ে যেটা বের হলো সেটি হচ্ছে দৈর্ঘ্যের গড় এবং পূর্ব বাহু এবং পশ্চিম বাহু যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ দিয়ে যা বের হলো সেটি হলো প্রস্থের গড়। এখন ওই জমির ক্ষেত্রফল অর্থাৎ ঐ জমির পরিমাপ বের করতে আপনাকে শুধুমাত্র দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ গুন করতে হবে। ব্যস হয়ে গেলো। তারপরও নীচে নমুনাটা দেখতে পারেন,
দৈর্ঘ্যের গড়=( উত্তর বাহু+দক্ষিণ বাহু)/২
প্রস্থের গড়=( পূর্ব বাহু+পশ্চিম বাহু)/২
ক্ষেত্রফল= দৈর্ঘ্যের গড় X প্রস্থের গড়।
এভাবেই আপনি আপনার জমির ক্ষেত্রফল তথা পরিমাপ বের করতে পারবেন। জমির প্রতিটি বাহু ফুটে বের করবেন, তাহলে ক্ষেত্রফল স্কয়ার ফুট বা বর্গ ফুটে বের হয়ে আসবে। আগামী পর্বে আমরা চেষ্টা করবো, ত্রিভুজ বা অন্য কোন আকৃতির জমির পরিমাপ কিভাবে নিজে নিজে বের করবেন, সে সম্বন্ধে।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )