লিমিটেশন অ্যাক্ট

তামাদি আইন জানার প্রয়োজনীয়তা এতো বেশি কেন?

তামাদি আইন

বাজার থেকে একটি রুটি বা পানীয় ক্রয় করলেও সেটিতে এর উৎপাদন এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ দেওয়া থাকে। প্রতিটি বিষয়েরই একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে, যার উত্তীর্ণ হওয়ার পর এর আর মূল্য থাকে না। কোন কোন ক্ষেত্রে মূল্য থাকলেও সেটি আবার অন্য কারো জন্য অকৃত্রিম উপায়ে ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে, কিছু ব্যতিক্রমও আছে যা নিয়ে বলাবাহুল্য।

আইন আমাদেরকে অধিকার, প্রতিকার, সুরক্ষার পাশাপাশি নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু, আইন কখনো অলস ব্যক্তিতে প্রতিকার দেয় না। আইন চায় সবাই সময়ের মধ্যে আইনের আশ্রয় বা আইনের সুবিধা গ্রহণ করুক। বলে না, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’; তেমনি আইনের বেঁধে দেওয়ার সময়ের মধ্যে আইনের আশ্রয় না নিলে আইনও সহযোগিতা করা হতে বিরত থাকবে।

আইনের এই সময় বেঁধে দেওয়ার যে নীতি এবং বৈশিষ্ট্য সেটি তামাদি আইনে স্পষ্টত করা হয়েছে। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে এসে সাধারন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে যখন একে একে আইন প্রণয়ন করা শুরু করে তখন ১৮৫৯ সালে সর্বপ্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে তামাদি আইন পাশ করা হয়। ১৮৫৯ সালে পাশ হলেও সেটি কার্যকর করা হয় ১৮৬২ সালে।

১৮৫৯ সালের তামাদি আইন পরিবর্তিত হয়ে দুই ধাপে প্রথমে ১৮৭১ সালে এবং পরবর্তীতে ১৮৭৭ সালে তামাদি আইন নামে পাশ করা হয়। কিন্তু আবার পরিবর্তিত হয়ে সর্বশেষ ১৯০৮ সালে পুনরায় ঐ ব্রিটিশ সরকারের অধীনেই তামাদি আইন নামে প্রবর্তন করা হয় যা বিভিন্ন সংশোধনীর পরেও এখনো বাংলাদেশে বিদ্যমান।

তামাদি আইন ১৯০৮ সালের ৯ নং আইন, যা ১৯০৯ সালের ১লা জানুয়ারী হতে কার্যকর হয়। তামাদি আইন মোটা দাগে দেওয়ানী মোকদ্দমায় ব্যবহার করা হলেও সামান্য কিছু ফৌজদারি ক্ষেত্রেও তামাদির প্রয়োগ রয়েছে। তামাদি আইন, ১৯০৮ দেওয়ানী কার্যক্রমে অর্থাৎ দেওয়ানী মূল মোকদ্দমা, আপীল, রিভিউ, আবেদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও ফৌজদারী মূল মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে তামাদি আইন প্রযোজ্য হয় না। কিন্তু, কিছু বিশেষ ফৌজদারী কার্যক্রম যেমন ফৌজদারী আপীল দায়েরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ফৌজদারি অপরাধের বিচার কিংবা আমাদের ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ফৌজদারি অপরাধের বিচার কিন্তু অনেক পরে শুরু হয়েছিল; এর কারণ হচ্ছে ফৌজদারি মূল মামলায় কোন তামাদি মেয়াদ নেই। ফৌজদারি বা ক্রিমিনাল অপরাধ যত আগেই হোক না কেন, এর বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা যেকোনো সময় করা যায়। তবে, ঘটনার সত্যতা প্রমানের জন্য যতদ্রুত সম্ভব মামলা দায়ের করতে হয়, নাহলে মামলার বিষয়বস্তু বা সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া, দেওয়ানী মামলায় প্রতিকার বা অধিকার এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম ভোগ করতে পারলেও ক্রিমিনাল মামলায় একজনের শাস্তি আরেকজনকে দেওয়া যায় না বলেই আসামী জীবিত থাকাবস্থায় তার বিচারকার্য শেষ করে তাকে সাজা দেওয়ার জন্যই যত দ্রুত সম্ভব মামলা দায়ের করতে হয়।

সিভিল বা দেওয়ানী মোকদ্দমায় কিন্তু তামাদি আইনের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই মোকদ্দমা দায়ের করতে হয়। অন্যথায়, তামাদির মেয়াদ শেষে দায়েরকৃত দেওয়ানী মোকদ্দমা খারিজ হবে। তামাদি আইনের বেঁধে দেওয়া মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর মামলা, আপীল বা দরখাস্ত দায়ের বা দাখিল করা হলে উক্ত মামলা, আপীল বা দরখাস্ত খারিজ বলে বিবেচিত হবে। এমনকি, বিবাদী পক্ষ যদি তামাদি মেয়াদ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন নাও করে, তবুও মেয়াদ উত্তীর্ণ মামলা, আপীল বা দরখাস্ত খারিজ হয়ে যাবে।

তামাদি আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর মামলা, আপীল বা দরখাস্ত দায়ের বা দাখিল করা হলে বিবাদী পক্ষ যদি তামাদির প্রশ্ন উত্থাপন নাও করে, তবুও উক্ত মামলা, আপীল বা দরখাস্ত খারিজ বলে বিবেচিত হবে এবং ৩ ধারার এই বিধান তামাদির আইনের ৪ থেকে ২৫ ধারার নিয়মাবলী সাপেক্ষে প্রয়োগ করা হবে। তামাদি আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী তামাদির বিষয়বস্তু ৩ টি, যথাঃ

  • মামলা,
  • আপীল এবং
  • আবেদনপত্র।

বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তামাদি আইনের ৩ ধারার এই বিধান আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ, তামাদির মেয়াদ শেষে দায়েরকৃত মোকদ্দমা খারিজ করে দিতে আদালত বাধ্য। তবে, আইনে সবসময়ই দুই যোগ দুই সমান চার হয় না, তেমনি ভাবে বিশেষ কোন ব্যতিক্রম বা যদি ভিন্ন কিছু প্রমাণ হয় তখন হয়ত ভিন্ন কিছুই ঘটতে পারে। 

আরেকটি সাধারন বিষয় তামাদি আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার সময় যদি আদালত বন্ধ থাকে, সেক্ষেত্রে যেদিন আদালত খুলবে সেদিনও তামাদির মেয়াদ রয়েছে বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ, যেক্ষেত্রে কোন মামলা, আপীল, দরখাস্তের জন্য নির্দিষ্ট তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণের দিন আদালত বন্ধ থাকে, সেক্ষেত্রে আদালত পুনরায় খোলার দিন উক্ত মামলা, আপীল বা দরখাস্ত দায়ের করা যাবে।

উদাহরণস্বরূপ, প্রতি মাসে আমাদের ইউটিলিটি বিল (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি) দেওয়ার একটি নির্দিষ্ট লাস্ট ডেট বা শেষ দিন থাকে, যা হচ্ছে মূলত মাসিক ইউটিলিটি বিল দেওয়ার তামাদি মেয়াদ। এখন, মাসিক ইউটিলিটি বিল দেওয়ার লাস্ট ডেটে যদি কোন কারনে ব্যাংক বন্ধ থাকে, তাহলে পরবর্তী যেদিনই ব্যাংক খুলবে সেদিনই ইউটিলিটি বিল জমা দেওয়া যাবে। তেমনি ভাবে তামাদি মেয়াদের শেষ দিন যদি আদালত বন্ধ থাকে, তাহলে যেদিন আদালত খুলবে সেদিনই মামলা বা আপীল বা দরখাস্ত দায়ের করা যাবে।

এখন অনেকেরই প্রশ্ন থাকে যে, আমার একটি ন্যায্য অধিকার শুধুমাত্র তামাদি মেয়াদের জন্য বাতিল হয়ে যাবে, এটা তো আমার উপর অন্যায়। আবেগ দিয়ে বিচার করলে প্রশ্নটি যৌক্তিক, তাই বলা হয়ে থাকে, তামাদি আইন অধিকারকে বিলুপ্ত করে না কিন্তু প্রতিকারকে বারিত করে, যাকে ইংরেজিতে বলে, Law of limitation bars a remedy not a right.

আপনার জমিতে আপনার যে অধিকার রয়েছে, সেটি কারো দ্বারা বাঁধাগ্রস্ত হলে এবং আপনি তামাদি মেয়াদ শেষে মামলা করলে আদালত মামলাটি খারিজ করবে। এতে আপনি আইনত প্রতিকার পেতে বঞ্চিত হলেন কিন্তু জমিতে আপনার অধিকার বিলুপ্ত হয়নি। তাই কাব্যিকভাবে বলা হয় যে, তামাদি আইন অধিকারকে বিলুপ্ত করে না কিন্তু প্রতিকারকে বারিত করে। এজন্যই তামাদি আইন সম্বন্ধে জানা এতোটা জরুরী, যাতে আইনি প্রতিকার হতে বঞ্চিত হতে না হয়। তামাদি আইন সম্বন্ধে আরও জানতে আমাদের নিম্নের আর্টিকেল গুলো পড়তে পারেনঃ

তামাদি আইন: কি, কেন, কিভাবে?

তামাদি আইনের ব্যতিক্রম: বৈধ অপারগতা

তামাদি মেয়াদ গণনা পদ্ধতিঃ পর্ব ০১

তামাদি মেয়াদ গণনা পদ্ধতিঃ পর্ব ০২

তামাদি মেয়াদ গণনা পদ্ধতিঃ পর্ব ০৩

তামাদি মেয়াদ গণনা পদ্ধতিঃ পর্ব ০৪

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.