আপনি সর্বোচ্চ কতটুকু সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন?

জমি-জমার আইন

একবার এক সাধু থেকে এক দরিদ্র কৃষককে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যে, আপনি সূর্য উদয়ের পরে আপনার বাড়ি থেকে বের হবেন, সারাদিন আপনি যতটুকু জায়গা বৃত্তাকারে হেঁটে এসে সূর্যাস্তের আগে আপনার বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন ততটুকু জায়গা আপনার নামে লিখে দেওয়া হবে বা আপনাকে মালিকানা দিয়ে দেওয়া হবে। এটা শুনে কৃষক তো মহা খুশি। যেমন প্রস্তাব তেমন কাজ, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই কৃষক ঘর থেকে বের হয়ে ঘরের দক্ষিণ দিক দিয়ে হাটা শুরু করল এবং মনস্থির করল যে সন্ধ্যা হওয়ার আগে এটা বিশাল বৃত্ত তৈরি করে উত্তর দিক দিয়ে এসে বাড়িতে পৌঁছাবে। সেই অনুসারে দুপুর পর্যন্ত হাঁটার পর কৃষকের একবার মনে হল যে, আমি অনেক দূরে চলে এসেছি এখন উত্তর দিকে হাঁটার পালা, তাহলে সন্ধ্যার আগে আমি বাড়ি পৌঁছাতে পারবো। কিন্তু কৃষকের আবার মনে হল যে, যদি আমি সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাড়ি পৌঁছে যায় তাহলে বাকি সময়টা তো আমার বৃথা যাবে, ওই সময় যদি আমি আরেকটু জমি হাঁটতে পারি তাহলে তো ওই জমির মালিকানা আমি পাব। এমন সুযোগ তো আর বার বার আসে না। যথা চিন্তা, তথা কাজ; হাঁটতে হাঁটতে সূর্য যখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়ল, তখন কৃষক উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করল। উত্তর দিকে হাঁটতে হাঁটতে যখন কৃষক দেখলো পড়ন্ত বিকেলে সে তার বাড়ী থেকে অনেক দূরে আছে এখনো, হেঁটে আর সে বাড়ি পৌঁছাতে পারবে না, তাই সে দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে দৌড়াতে কৃষক হাঁপিয়ে উঠলো। কিন্তু সাধু প্রস্তাবে বলে দিয়েছিল যে, সূর্যাস্তের আগে অবশ্যই একটি বৃত্ত তৈরি করতে হবে, তাই কৃষক মরিয়া হয়ে বৃত্ত তৈরি করার জন্য তার বাড়ির পথে ছুটতে ছুটতে বাড়ির কাছাকাছি এসে লুটিয়ে পড়ে গেল। চারদিক হলদেটে করে সন্ধ্যা নেমে এলো; কৃষকের আর বৃত্ত ভরাট করা হল না। পড়ে রয়েছে কৃষকের নিথর শরীরটি; কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, সারাদিনের অভুক্ত শরীর, পরিশ্রান্ত দেহ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আর টিকলো না।
এই গল্প থেকে আমরা কি শিখলাম?- সেই প্রাচীন প্রবাদটি নয়, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু?

যদিও আমার মনে হয় যে, লোভ থাকা ভালো। মানুষ লোভ করেছে বলেই আজকে চাঁদে পৌঁছাতে পেরেছে। চাঁদে যাওয়ার লোভ না করলে কখনোই মানুষ চাঁদে যেতে পারতো না, পারতো না আকাশে উড়তে। তাই বরং এটা বলা যায় যে, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। অতি লোভ ভালো নয়; কৃষক যদি অতিরিক্ত সম্পত্তির লোভ না করত, তার শক্তি এবং সামর্থ্য অনুযায়ী একটা বৃত্ত তৈরি করতো তাহলে সে সম্পত্তি ও পেতো, বেঁচে থাকত এবং তা ভোগ দখল করতে পারত। আমাদের জীবনেও আমরা আমাদের চারপাশে এমন অনেক লোকদেরকে দেখতে পাই যারা সারাজীবন শুধু সম্পত্তি অর্জনের পিছনেই ছুটছে, না ঠিকমত সম্পত্তি ভোগ করে যেতে পেরেছে না, ঠিকমত নিজের জীবনটা উপভোগ করে যেতে পেরেছে। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল নয়, প্রত্যেকটা জিনিসের একটি সীমা থাকা উচিত। এজন্যই আল্লাহ সুবহানাতায়ালা বলেছেন, “তোমরা অসীমে যাও কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না”।



যাই হোক এসব গেলো নৈতিক কথাবার্তা, এবার আসুন আইনে। আমরা আসলে সর্বোচ্চ কতটুকু সম্পত্তির মালিক হতে পারব, এই নিয়েই আজ আলোচনা করবো। আমাদের দেশে এক সময় সম্পত্তি অর্জনের তেমন কোন বিধি নিষেধ ছিল না। এর মূল কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের সম্পত্তির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার মতো কোন আইন ছিল না; দেশে ছিল রাজাদের শাসন, তারাই মালিক ছিল জমির। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিভিন্ন আইন এর মাধ্যমে সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে লাগাম টানা হয়েছিল। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর পরই রাষ্ট্রীয় প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ১০০ বিঘের একটি লিমিটেশন সেট করা হয়। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০০ বিঘে সম্পত্তির মালিক হতে পারবে। এক দশক পরে পঁচাত্তরের নামিয়ে নেয়া হয় তারও প্রায় এক দশক পরে সেটিকে আবার ১০০ বিঘেতে উঠিয়ে আনা হয়। কিন্তু সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ যেটি বর্তমানে এখনও প্রচলিত আছে, সেই অধ্যাদেশে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৬০ বিঘে জমির মালিক হতে পারবেন। এখানে একজন ব্যক্তি বলতে পাশাপাশি একটি পরিবারকেও বুঝাবে। একটি পরিবার যৌথভাবে এটা একটু বলি, আপনার বাবা এখন সর্বোচ্চ ৬০ বিঘে জমির মালিক হতে পারবেন কিন্তু আপনার বাবা মারা যাওয়ার পরে ওই সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে আপনারা মালিক। সেক্ষেত্রেও যৌথভাবে আপনারা ৬০ বিঘে জমির মালিকানা অর্জন করতে পারবেন।

 

তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম যে, একজন ব্যক্তির বা পরিবার যৌথভাবে ৬০ বিঘে জমির মালিক হতে পারবে, এখন ৬০ বিঘা জমি বলতে কতটুকু সেটি সম্বন্ধে একটু আলোচনা করে নেয়া যাক। কারণ, আমাদের দেশের বিঘার হিসেব অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন রকম। এক্ষেত্রে ১ বিঘা= ৩৩ শতাংশ হিসেব করা হবে যা মোট গিয়ে দাঁড়ায় ১৯৮০ শতক বা শতাংশ, আবার কাঠার হিসেবে গেলে ১২০০ কাঠা।

বিঘা শতক/শতাংশ কাঠা
৬০ ১৯৮০ ১২০০

এখন আপনার মনে দুটো প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রথমত যদি একজন ব্যক্তি ৬০ বিঘে জমির বেশি মালিক থাকে, একজন ব্যক্তির সেই ক্ষেত্রে বাড়তি সম্পত্তিতে কি করা হবে?
যেহেতু আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ৬০ বিঘে জমির বেশী মালিকানা আপনার থাকতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে আপনাকে ধরে নিতে হবে আপনার বাড়তি সম্পত্তিটি আইনত অবৈধ, সেক্ষেত্রে জমির মালিকানা সরকার গ্রহণ করতে পারবে। তবে এখানে একটা ছোট সুযোগ রয়েছে যেটি আপনি চাইলেই নিতে পারেন, সেটি হচ্ছে ৬০ বিঘে জমির বাহিরে যদি কোন জমি আপনার মালিকানায় থাকে, আর সেটি যদি দান বা হেবা সূত্রে পেয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে সেই সম্পত্তিটি সরকার আপনাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে সরকারী সম্পত্তি বা খাস সম্পত্তিতে পরিণত করবে। কিন্তু ক্রয়সূত্রে যদি হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে আপনি কোন প্রকারের ক্ষতিপূরণ পাবেন না, সেটি সরকার ক্ষতিপূরণ প্রদান ব্যতীতই সরকারী সম্পত্তি বা খাস সম্পত্তি করে নিবে।

দ্বিতীয়ত, যদি এই আইনটি বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই আপনি বা আপনার পরিবার ৬০ বিঘা জমির চেয়ে বেশি জমির মালিক হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে কি হবে? যেহেতু এই আইনটির কার্যকারিতা ১৯৮৪ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এবং কোন রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্ট নেই, সে ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হবে যে এই আইনটি ২৬ জানুয়ারি বা তারপর থেকে কার্যকর হবে। কোনমতেই এর আগের কোন কার্যক্রমকে এটি এফেক্টেড বা আক্রান্ত করবে না।

অর্থাৎ আপনি যদি ১৯৮৪ সালের আগেই ৬০ বিঘের চেয়ে বেশী জমির মালিকানা থাকে, সেক্ষেত্রে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ কোন ভাবে আক্রান্ত করবে না। তারপরও ভালো হচ্ছে, ৬০ বিঘে জমির বেশী মালিকানা থাকলে সেটি একাধিক ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করে ৬০ বিঘের নিচে নামিয়ে নেওয়া। আশা করি, কতটুকু জমির মালিকানা আপনি বা আপনার পরিবার যৌথভাবে অর্জন করতে পারবেন, তা বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.