বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে, ছোটবেলায় আমরা ভাব সম্প্রসারণের জন্য পড়েছিলাম। মুখস্থই করে গেছি আমরা, এর প্রকৃত ভাবটা আজও সম্প্রসারণ করে যেতে পারিনি। আমরা যদি ভাব সম্প্রসারণটা ঠিক মত করতে পারতাম, তাহলে আজকে পৃথিবী এতো উষ্ণ হতো না, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সাথে সাথে আপনার আমার অন্তর আত্মা এতো হাঁসফাঁস করতো না।
আদিবাসী বা উপজাতি শব্দগুলো নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তাই বিতর্কে না গিয়ে আমি বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে পরিচয়পত্রসহ নিজ দেশ মনে করা সকল ধর্ম, বর্ণ, জাত, শ্রেণীর লোকদেরকেই বাংলাদেশী মনে করি। এখন শুধু আদিকাল বা জমির শ্রেণীর ভিত্তিতেই আমরা হয়ত সমতলে আছি আর কেউ পাহাড়ে আছে। যদিও আদিবাসী বা উপজাতিদের সবাই যে পাহাড়ে থাকে, তাও কিন্তু নয়। হয়ত পাহাড়েই ছিল, কালের বিবর্তনে পাহাড়ও এখন কেটে সমতল হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, সরকারি গেজেট অনুসারে যারা আদিবাসী বা উপজাতি তাদের জমি ক্রয় করার বিষয়েই আজকের আর্টিকেল।
বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে; ঠিক তেমনিভাবে সমতলের মানুষ সমতলে আর পাহাড়িরা পাহাড়ে। সমতলের মানুষ পাহাড়ের গুরুত্ব বুঝে না, বুঝে শুধু কেটে সমতল করতে। তবুও, জীবিকা, পড়াশোনা, ভ্রমণের জন্য মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেই পারে। কিন্তু যদি কারো কোন জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়াকে অন্য জায়গার স্থানীয়রা ওয়েলকাম না করে, সেক্ষেত্রে সেই জায়গায় যাওয়াটা অনেকটা অনধিকার প্রবেশের মত। সেখানে স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয় তো বেশ জটিল; আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও তেমন।
শুধুই যে আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়। এক দেশ থেকে গিয়ে আরেক দেশ, এক জেলা থেকে গিয়ে আরেক জেলা বা এক অঞ্চল থেকে গিয়ে আরেক অঞ্চলে জমি ক্রয় করার বেলায় একটা বাড়তি আনুষ্ঠানিকতা আছে, যাকে আমরা জটিলতাও বলতে পারি। যেমন ধরুন, অগ্রক্রয়।
বিভিন্ন আইনেই অগ্রক্রয় দ্বারা আগন্তুকদেরকে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে যাতে হুট করে বাহির থেকে কেউ এসে জমি ক্রয় করে অবস্থান নিতে না পারে। আমার সবসময়ই চাই আমাদের প্রতিবেশীরা আমাদের জানাশোনা মানুষ হোক, কখনোই অচেনা অজানা কেউ আমাদের প্রতিবেশী হোক এটা আমরা কখনোই কামনা করি না।
পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মানুষ যতটাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখুক না কেন, আপনার বাসার নিচে কিংবা আপনার বাড়ির আঙ্গিনায় একজন অস্ত্রধারী পুলিশ থাকাটাকে আপনি যতটা নিরাপদ মনে করবেন, একজন সন্ত্রাসী অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনি কিন্তু ততটা নিরাপদ বোধ করবেন না।
একইভাবে প্রতিবেশী যেমনই হোক সে যদি জানাশোনা মানুষ হয়, অনেক দিনের পুরনো হয়, সেক্ষেত্রে সেটি সহনীয়। কিন্তু হুট করে আগন্তুক কেউ একজন যদি এসে যায় তখন সেটি বড়ই অস্বস্তিকর। এজন্যই জমিজমা বিক্রি করার ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়ের আইনটিকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়। মুসলিম আইন অনুসারেও যেমন অগ্রক্রয়ের কথা বলা হয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় আইনেও অগ্রক্রয়ের কথা বলা হয়েছে।
এখন একইভাবে পাহাড়ে বা বিভিন্ন জায়গায় যেসব আদিবাসী বা উপজাতি রয়েছে, তাদের সম্পত্তি কেনাবেচার ক্ষেত্রেও কিছু বিধি নিষেধ রয়েছে। আপনি চাইলে হুট করে একটি আদিবাসীর জমি ক্রয় করতে পারবেন না। কিন্তু যদি কখনো পরিস্থিতির শিকার হয়ে বা প্রয়োজনের তাগিদে বাহিরের কেউ অর্থাৎ যে কিনা আদিবাসী বা উপজাতি নয় কিন্তু সে আদিবাসী বা উপজাতির জমি ক্রয় করতে চায় এবং জমির যে মালিক সেই আদিবাসী যদি জমি বিক্রি করতে সম্মত হয়, সেক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই এসি ল্যান্ডের কাছে আগে দরখাস্ত করতে হবে। এসি ল্যান্ড যদি অনুমতি দেয় সেক্ষেত্রেই কেবলমাত্র আদিবাসী বা উপজাতিদের জমি বাহিরের কেউ একজন ক্রয় করতে পারবে। রেফারেন্স হচ্ছে, ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারা। এটা কেবল একটা বাড়তি অনুমতি, যেটি অন্য জমির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না।
মজার বিষয় হচ্ছে এখনকার দিনে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অনেক প্রবাসী ছেলে মেয়ে আমাদের দেশে চলে আসছে বিয়ে করার জন্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোর সহজলভ্যতার কারণে দুনিয়ার এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত মানুষের যোগাযোগ হচ্ছে, প্রেম-ভালোবাসার বিনিময় হচ্ছে এবং ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন রং, ভিন্ন বর্ণের মানুষের সাথে বিবাহ হচ্ছে।
একই জিনিস আদিবাসী বা উপজাতিদের সাথে হতে পারে। আদিবাসী সাথে যারা আদিবাসী নয় তাদের প্রেম ভালবাসা হতে পারে, উপজাতির সাথে যারা উপজাতি নয় তাদের বিয়ে সংসার হতে পারে। সেক্ষেত্রেও যদি বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে যদি কোন সম্পত্তি দান বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করতে চায়, সেক্ষেত্রেও দরখাস্ত করতে হবে। রাজস্ব অফিসার বা এসি ল্যান্ড অনুমতি না দিলে সেক্ষেত্রে সম্পত্তি হস্তান্তর করা যাবে না। কেননা, ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারার ৪ উপধারায়, শুধু বিক্রির কথা বলা হয়নি, সেখানে দান ও উইল করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য যেকোনো দেশের মোট জমির শতকরা ২৫ ভাগ অর্থাৎ ৪ ভাগের ১ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ, বাংলা নিউজ২৪ এর জুন ৪, ২০২৩ এর রিপোর্ট অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশে আছে মাত্র ১৫ দশমিক ৫৮ ভাগ, যেটা কিনা ৬ ভাগের ১ ভাগ। তাই, যারা উপজাতি বা আদিবাসী নয়, তারা যদি কোন উপজাতি বা আদিবাসী জমি ক্রয় করে সেক্ষেত্রে কোনোভাবেই ওই জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা উচিত নয়।
তবে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহ বন্ধনটাকে উৎসাহিত করা উচিত। সবাই সবার সাথে মিশতে মিশতে যখন সারা দুনিয়াতে একটা জাতিতে পরিণত হবে, তখন ভেদাভেদটা অনেক কমে যাবে। দেশে দেশে এত লড়াই সেখানে যদি এক দেশের মধ্যে আবার অনেকগুলো জাতিতে বিভক্ত থাকে সেক্ষেত্রে না দেশের বাহিরে শান্তি পাওয়া যাবে, না দেশের মধ্যে। তাই, পুরো দুনিয়াতে যদি একটি জাতি থাকতে (হোক না সেটি মিশ্রিত, আমরা তো সবাই এসেছিলাম এক আদম হাওয়া থেকে, তাই না?) এবং সবাই আমরা এক জাতি হতাম তাহলে হয়তো দুনিয়ার এই হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি কমে যেতো।

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )