দখল ও দলিলের সমস্যা

দলিলে এবং দখলে গড়মিল – ক্রেতার করণীয়: পর্ব ২

জমি-জমার আইন

আগের পর্বের ধারাবাহিকতায় আজকে আমরা আলোচনা করব, আপনি একজন ক্রেতা হিসেবে যদি কোন বিক্রেতার কাছ থেকে কোন একটি জমি ক্রয় করার পরে আপনি গিয়ে দেখলেন যে ওইখানে জমির পরিমাণ চুক্তিতে উল্লেখিত জমির পরিমাণের অর্ধেক বা তারও কম। সেই ক্ষেত্রে আপনার করনীয় কি?
ধরুন আপনি একজন বিক্রেতার কাছ থেকে ১০ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন কিন্তু ওই ব্যক্তি ওই জমির ৫ শতাংশ বা তারও কম অংশের মালিক। সেই ক্ষেত্রে আপনারা চাইলে উভয় পক্ষ মিলে যদি চুক্তিটি বাতিল করতে চান, সেই ক্ষেত্রে উভয়ের সম্পত্তিতে উক্ত দলিলটি বাতিল করতে পারবেন। কিন্তু, যদি আপনি ক্রেতা হিসেবে মনে করেন যে, আপনি উক্ত চুক্তিটির যতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব ততটুকুই করবেন, অর্থাৎ ছোট অংশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হওয়ায় ছোট অংশ বাস্তবায়ন করবেন এবং বাকি যে অংশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না, সেই অংশের জন্য বাড়তি ক্ষতিপূরণের অধিকার পরিহার করে তবেই কেবল ক্রয়মূল্যের জন্য আবেদন করে সেটি ফেরত দেওয়া সম্ভব। আরও সহজ ভাষায় বললে, আদালতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি ক্রেতা যদি চান বিক্রেতা বৈধ ভাবে যতটুকু জমির মালিক, আমি ঠিক ততটুকুই যোগ্য ক্রয়মূল্য পরিশোধ করার মাধ্যমে ক্রয় করবো আর বাকি অংশ যেহেতু বিক্রেতা কোন মতেই আমাকে হস্তান্তর করতে পারবে না হোক সেটা তার নিজের কারণে বা অন্য তৃতীয় কোন পক্ষের কারণে, সেক্ষেত্রে আমি বাকি অংশের জন্য যদি অর্থ পরিশোধ করে থাকি সেটি ফেরত পেতে পারবো কিন্তু কোন মতেই ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারবো না। আগের পর্বে আমরা দেখেছিলাম ক্ষতিপূরণের অধিকার রয়েছে কিন্তু এই ক্ষেত্রে আপনি ক্রেতা হিসেবে কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না। আপনাকে ক্ষতিপূরণের অধিকারটা বাদ দিয়ে মানে আপনি ক্ষতিপূরণের দাবি না করেই আপনাকে শুধুমাত্র যতটুকু জমি রয়েছে ততটুকুর উপর দলিল বা চুক্তি সম্পাদনের জন্য আবেদন করে আদালতের কাছে যেতে হবে। এটাই একমাত্র উপায় চুক্তিটি আংশিকভাবে হলেও বাস্তবায়ন করার, অন্যথায় এই চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো না।

 

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১৪ এবং ১৫ ধারায় আমরা দেখলাম যে, কোন একটি চুক্তি যদি আংশিকভাবে সম্পাদন যোগ্য হয় তাহলে বাকি অংশ কিভাবে ক্ষতিপূরণের ভিত্তিতে অথবা শুধুমাত্র সম্পাদিত অংশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন সম্ভব। এরই ধারাবাহিকতায় সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১৬ ধারায় দেখতে পাবো, আমরা কিভাবে আরো অনেক ধরনের ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করতে পারি। ধরুন একজন ব্যক্তি আপনার কাছে ২ বা ৩ দাগে সম্পত্তি বিক্রি করেছে। এই টেকনিক্যাল বিষয়টা একদমই সচরাচর ঘটে থাকে। যারা একেবারেই জমিজমা সম্বন্ধে ধারণা রাখেন না, তাদের জন্য জটিল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে একটি হস্তান্তরিত জমি সবসময় একই দাগের মধ্যে থাকবে সেটি কিন্তু নয়। কয়েকটি দাগের মধ্যে একটি জমি বিক্রি হতে পারে আবার একই দলিলে কয়েকটি দাগের ভিন্ন ভিন্ন জমিও বিক্রি করাতে হতে পারে। এখন একাধিক দাগের জমি বিক্রি করার ফলে আপনি গিয়ে দেখলেন একটি দাগ ব্যতীত বাকি দাগগুলোতে ওই লোকের বৈধ মালিকানা নেই। সে ক্ষেত্রে বাকি যে এক বা একাধিক দাগ রয়েছে সেই দাগের জমি আপনি ক্রয় করতে চাইলেও যেহেতু ওই লোকের বৈধ মালিকানা নেই সে ক্ষেত্রে আপনি আবার জটিলতায় পড়ে গেলেন। আপনার যেহেতু সম্পূর্ণ চুক্তি কার্যকর করা যাচ্ছে না, তাহলে কি পুরো চুক্তি বাতিল হবে নাকি বাকি অংশের জন্য ক্ষতিপূরণ বা চুক্তি মূল্য ফেরত পাবেন; যখন এইসব নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি তখন সমাধানের উপায় সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১৬ ধারায়। এই ধারা অনুযায়ী স্বতন্ত্র অংশের সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন করা সম্ভব। এখন যেহেতু বিক্রেতার একটি দাগে মালিকানা রয়েছে, অন্য দাগে নেই, সেক্ষেত্রে আপনি যেই দাগে বিক্রেতার মালিকানা আছে সেই দাগের উপর সুনির্দিষ্টভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারবেন। বাকি দাগগুলোর জন্য আপনি আগের ধারাগুলোর মত ক্রয় মূল্য ফেরত পাবেন।




এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে আমরা অনেক সময় সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেক কিছু করে থাকি বিশেষ করে জমিজমা ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আমরা জমির প্রকৃত যে মূল্য সেটি যদি মৌজা রেট এর চাইতে বেশী হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আমরা শুধু মৌজা রেট অনুসারেই দেখিয়ে থাকি। জমির মূল্য ১ লক্ষ টাকা শতাংশ প্রতি, যেখানে কিনা মৌজা রেট হচ্ছে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা। এখন আপনি মাথায় রাখতে হবে রেজিস্ট্রেশন খরচটি নির্ধারণ করা হয় জমির মোট মূল্যের উপর। সে ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত শুধুমাত্র মৌজা রেট টা দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে থাকি, যাতে আমাদের হস্তান্তর দলিলের সরকারি রেজিস্ট্রেশন ফি’টা কম আসে। কিন্তু উপরে আমরা যে আলোচনা করেছি সেই অনুসারে যদি আপনার কিছু জমি কম থাকে যেমন ধরুন এক শতাংশ জমি কম রয়েছে সেটার জন্য আদালত আপনাকে ক্রয় মূল্য হিসেবে ১ শতাংশ জমির মূল্য ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিবেন। সে ক্ষেত্রে আপনি কিন্তু ওই মৌজা রেট পাবেন; যদি না বিক্রেতা আপনাকে প্রকৃত মূল্য ফেরত না দেয়। আদালত তো দলিলে উল্লেখিত মূল্যকেই প্রকৃত মূল্য হিসেবে ধরে নিবেন। তাই, সর্বদা জমির প্রকৃত মূল্যই দলিলে উল্লেখ করা উচিত, কমও না বেশীও না। কম হলে কি সমস্যা হবে আবার বেশী হলেও কি কি সমস্যা হতে পারে, সেটি নিয়ে সামনে বাস্তবসম্মত উদাহরণ নিয়ে লিখবো।

 

দুইটি পর্ব এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১৪, ১৫ এবং ১৬ ধারা আশা করি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। তবে, এই ধারায় আপনি ঝামেলায় পড়ে প্রতিকার পাবেন। কিন্তু, আমরা জানি Prevention is better than cure. কেমন হয়, আমরা একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে এমন পরিস্থিতিতেই না পড়লাম। আমরা যে দুই পর্বে আলোচনা করেছি ৩ ক্ষেত্রেই আপনাকে চুক্তি অনুযায়ী অর্থাৎ দলিলে উল্লেখিত জমির পরিমাণ বুঝে না পাওয়ার জন্যই প্রতিকার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে প্রতিকারটুকু আপনাকে আদালতে মামলা করার মাধ্যমেই আদায় করতে হবে। কেন শুধু শুধু নিজের হক হালাল টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করার পরে আবার আদালতের আঙিনায় দৌড়াদৌড়ি করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে বা জমি বুঝে পেতে হবে। তাই অবশ্যই লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করার আগে সামান্য কিছু টাকা খরচ করে জমিটি আগে মেপে দেখবেন। প্রয়োজনে লেনদেন করার আগেই বিক্রেতার মাধ্যমে জমির চৌহদ্দি নির্ধারণ করে খুঁটি (প্রয়োজনে অস্থায়ী খুঁটি) স্থাপন করবেন যাতে আশেপাশে কারো উক্ত জমির সীমানা নিয়ে আপত্তি থাকলে সেটা আপনি ক্রয় করার আগেই জানতে পারেন। সীমানাও নির্ধারণ হয়ে গেলো, জমির পরিমাণও আপনার জানা হয়ে গেলো; এবার সেই অনুযায়ী দলিল করলে জমি ক্রয় করার পরে আপনাকে আর আদালত প্রাঙ্গণে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। আজ এতটুকুই; পড়ুন, জানুন, বুঝুন, সচেতন হোন, বিপদ এবং জটিলতা এড়িয়ে চলুন।

 [পূর্বের পর্ব-০১ ]

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.