বায়না দলিল করার পর জমি বিক্রি করতে না চাইলে

বায়না দলিল করার পর জমি বিক্রি করতে না চাইলে

রফিক সাহেব বিদেশ থেকে এসে আব্দুর রহমানের কাছ থেকে একটি জমি ক্রয় করার জন্য একমত হয়। দাম নির্ধারণ করার পর রফিক সাহেব স্থানীয় এক দলিল লেখকের মারফত জমির নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক দিয়ে বায়না দলিল করেন। বায়না দলিলে উল্লেখ ছিল আগামী ৬ মাসের মধ্যে রফিক সাহেব বাকি টাকা পরিশোধ করার সাথে সাথেই আব্দুর রহমান উক্ত জমি সাফ কবলা দলিল করে রফিক সাহেবকে মালিকানা হস্তান্তর করে দিবেন। কিন্তু, আব্দুর রহমানের কাহিনী ভিন্ন। আব্দুর রহমান মূলত সাময়িক অসুবিধায় পড়ে তার ঐ জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক হয়েছিল। রফিক সাহেব যখন বায়না দলিল বাবদ অর্ধেক টাকা পরিশোধ করেন, সেই টাকা দিয়েই আব্দুর রহমান তার সাময়িক অসুবিধা থেকে কেটে উঠেন। বিপদ কেটে গেলে মানুষ নাকি অহংকারী হয়ে উঠেন, আব্দুর রহমানও পাল্টে গেলেন। তিনি এখন এই অল্প দামে জমি বিক্রি করতে চান না। তিনি অসুবিধায় পড়েছেন বলে, তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রফিক সাহেব অল্প দামে জমির বায়না দলিল করিয়ে নিয়েছেন, অথচ এই জমির প্রকৃত মূল্য আরও অনেক বেশি ইত্যাদি অজুহাতে আব্দুর রহমান সাহেব আর জমি বিক্রি করতে আগ্রহী নন। এই দিকে রফিক সাহেব ওনার নিজের কাছে গচ্ছিত টাকা দিয়ে বায়না করেছেন আর বাকি টাকা তিনি ঋণ করে পরিশোধ করার যে পরিকল্পনা ছিল, সেই অনুসারে তিনি বেশ অনেক দূর অগ্রসরও হয়ে গেছেন। এখন আব্দুর রহমান সাহেব যে কোন মতেই জমি বিক্রি বা সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশন করে দিতে রাজি নন। রফিক সাহেব এলাকার সকল সালিশের দ্বারস্থ হলেন, দলিল লেখক নিজে মধ্যস্থতা করলেন, তবুও আব্দুর রহমান মোটেও জমি বিক্রি করতে রাজি নন। তিনি রফিক সাহেবের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে দিবেন বলে বলছেন, তবে সবাই জানে তিনি অতি সহসায় উক্ত টাকা পরিশোধ করতে পারবেন না। তাই, সকলের দাবী হচ্ছে জমিটির বিক্রি সম্পন্ন করা হোক, কেননা আব্দুর রহমানের উদ্দেশ্য ভালো নয় বলে সকলেই অবগত। এমতাবস্থায়, রফিক সাহেব কি করতে পারেন?

রফিক সাহেব বা যারা বায়না দলিল এবং বায়না টাকা পরিশোধ করার পরও দলিল রেজিস্ট্রেশন পায় না বা বিক্রেতা জমির দলিল রেজিস্ট্রেশন না করে দিলে যে যে পদক্ষেপ নিতে পারেন, তা আমরা নিম্নে একে একে আলোচনা করবো।

  • পদক্ষেপ ১- রফিক সাহেব তথা বায়না দলিল সূত্রে গ্রহীতা যদি ইচ্ছে করেন তাহলে আব্দুর রহমান তথা বায়না দলিল সূত্রে দাতাকে সময় দিতে পারেন যাতে বায়না মূলে দেওয়া টাকা পরিশোধ করতে পারেন। এটি শুনতে অতিমানবীয় মনে হলেও অনেক সময় এটি করেই ঝামেলা মুক্ত উপায়ে এই বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়।
  • পদক্ষেপ ২- রফিক সাহেব তথা বায়না দলিল সূত্রে গ্রহীতা আব্দুর রহমান তথা বায়না দলিল সূত্রে দাতাকে চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন করার জন্য আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন রয়েছে। রফিক সাহেব যেহেতু বায়না চুক্তি করেছেন এবং আব্দুর রহমান সাহেব সজ্ঞানে স্বাক্ষর করে বায়নার অর্থও গ্রহণ করেছেন, সেহেতু আব্দুর রহমান সাহেব যুক্তি সঙ্গত কারণ দেখাতে ব্যর্থ হলে উক্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করতে তাকে বাধ্য করা যাবে। সেক্ষেত্রে আদালত যদি চুক্তি সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা মনে করেন, তাহলে উক্ত জমি বিক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করার আদেশ দিবেন। এতে রফিক সাহেব তথা বায়না দলিল সূত্রে গ্রহীতা বাকি টাকা পরিশোধ করে আব্দুর রহমান তথা বায়না দলিল সূত্রে দাতার কাছ থেকে দলিল রেজিস্ট্রেশন করে নিতে পারবেন। আদালত যদি বাকি টাকা আদালতে জমা দেওয়ার আদেশ দেন, তাহলে আদালতেই টাকা জমা দিতে হবে।
  • পদক্ষেপ ৩– রফিক সাহেব তথা বায়না দলিল সূত্রে গ্রহীতা আব্দুর রহমান তথা বায়না দলিল সূত্রে দাতার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবেন।

তবে, ক্ষতিপূরণের আবেদন করে ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেলে বা ব্যর্থ হলে, পরবর্তীতে চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নের জন্য মোকদ্দমা করা যাবে না। ক্ষতিপূরণের মোকদ্দমা চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নের মোকদ্দমার সাথেই দায়ের করতে হবে। অন্যথায়, মোকদ্দমা আইনের দ্বারাই বারিত হবে।

বায়না দলিল নিয়ে কিছু খুচরো প্রশ্ন উত্তর

  • সব দলিলের ক্ষেত্রেই কি বায়না দলিল প্রয়োজন?
    – না। শুধুমাত্র সাফ কবলা দলিলের পূর্বেই বায়না দলিল করা হয়ে থাকে। দান বা হেবা দলিল সমূহে বায়না দলিল প্রয়োজন হয় না।
  • যদি বায়না দলিলে কোন সময় উল্লেখ না থাকে?
    – বায়না দলিলের কত দিনের মধ্যে মূল দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, তা যদি বায়না দলিলে উল্লেখ না থাকে, তবে বায়না দলিলের তারিখ থেকে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সাফ কবলা দলিল সম্পন্ন করতে হবে।
  • বায়না দলিল করার পর বায়না দলিল মূলে ক্রেতা কি সুবিধা পেতে পারেন?
    – বায়না দলিল করার পর বায়না দলিল মূলে ক্রেতা জমিতে সাইনবোর্ড লাগাতে পারবেন। সাইনবোর্ডে তিনি উল্লেখ করতে পারবেন যে, তিনি উক্ত জমি ক্রয়ের জন্য বায়না দলিল সম্পন্ন করেছেন। তাছাড়া, তিনি উক্ত জমিতে যদি বাড়ি বা অন্য কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করতে চান, তাহলে সেই অনুযায়ী অনুমতি বা ছাড়পত্র নেওয়ার কাজগুলোর জন্য আবেদন করতে পড়বেন।

উল্লেখ্য, বায়না দলিল থেকে আপনি যত ধরনের আইনি সুযোগ সুবিধা নিতে চাচ্ছেন, তার পূর্ব শর্ত হচ্ছে আপনার বায়না দলিলটি অবশ্যই সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে হবে। রেজিস্ট্রেশন হীন বা অনিবন্ধনিত বায়না দলিল থেকে কোন আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে না।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

খাস জমি কি, কোন গুলো এবং এর ইতিহাস

একই জমি দুইজনের নাম নামজারি থাকলে করনীয় কি?

জোর করে জমি দখল করতে চাইলে করনীয়