চোরাই মাল কেনা বেচা

চোরাই মাল ক্রয় বা গ্রহণ কি অপরাধ?

ফৌজদারি আইন

কিছুদিন আগে একটি মফস্বল শহরে একটি ইমারতের কাজ চলছিল এবং একাধিক মিস্ত্রির সাথে একাধিক হেল্পার বা সহযোগী বা গ্রাম্য ভাষায় যোগালি কাজ করছিল। এখন এই যোগালি বা হেল্পারদের মধ্যে একটি ছেলে পরপর দুইদিন কাজে অনুপস্থিত ছিল।
দুইদিন পর যখন সে আসলো তখন তার কাছে কারণ জানতে চাওয়া হলে সে, যে ঘটনাটি বলল তা অনেকটা এমন যে, আজ থেকে মাস খানিক আগে তার পরিচিত এক লোকের কাছ থেকে একটা মোবাইল ফোন ক্রয় করেছিল ৫,০০০/- টাকার বিনিময়ে; মোবাইল ফোনটি ছিল সেকেন্ড হ্যান্ড। এখন মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করার কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকা থেকে পুলিশ কল করে জানিয়েছে যে, মোবাইলটি চোরাই ফোন। ঢাকার একজন ব্যক্তির কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি চুরি করা হয়েছে। সে যাতে মোবাইলটি ঢাকায় উক্ত পুলিশ ষ্টেশনে এসে দিয়ে যায়।

কিন্তু বেচারা বিষয়টি বুঝতে না পেরে উল্টো পুলিশকে বলল, এই ফোন তার নিজের টাকায় কেনা, সে এটি চুরি করেনি। সে বরং কনফিডেন্সের সাথে পুলিশের কাছে প্রমাণ চাইলো যে এই মোবাইল যে চোরাই তার প্রমাণ কি?
পুলিশ আর কথা বাড়াল না, পুলিশ ঐ ছেলের এলাকার থানায় বিষয়টি জানালো। এরপরে কিছুদিন আর কোন যোগাযোগ ছিল না, হুট করে একদিন ঐ মফস্বল শহরের পুলিশ ঐ ছেলের বাসায় এসে তাকে গ্রেফতার করে। তখন সে পুলিশকে জানায় যে, এই মোবাইলটি সে চুরি করে নাই এবং সে জীবনেও ঢাকা শহরে যায়নি। উল্লেখ্য, মোবাইলটি ঢাকা শহরের একজন ব্যাংক কর্মকর্তার, তিনিও ঐ মফস্বল শহরে কখনো আসেননি।

তখন আশপাশের সবার কাছ থেকে শুনে যখন পুলিশ কনফার্ম হয়ে যে ছেলেটি আসলে মোবাইল চোর নয়, সে একজন রাজ মিস্ত্রী (আসলে যোগালি), সে একজনের কাছ থেকে কম দামে সেকেন্ড হ্যান্ড হিসেবে ক্রয় করেছি; তখন পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। পুলিশ যদিও যার কাছ থেকে ক্রয় করেছে তার পরিচয় জানতে চেয়েছে, কিন্তু ছেলেটি জানলেও ওই লোকের পরিচয় পুলিশকে দেয়নি। কারণ ওই লোক ছেলেটির দূর সম্পর্কের আত্মীয় বটে।

এই যাত্রায় এলাকাবাসীর সহায়তা এবং পুলিশের মানবতার কারণে চোরাইমাল থাকা সত্ত্বেও ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও আইনত চোরাইমাল যার কাছে পাওয়া যায়, তাকেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ছেলেটির কপাল ভালো যে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে, অন্যথায় এই ছেলের কাছে চোরাইমাল পাওয়ার কারণে তাকে যেমন দোষী সাব্যস্ত করা যেত, একইভাবে যার কাছ থেকে সে চোরাই মোবাইল ক্রয় করেছিল তাকেও অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা যেতো; পাশাপাশি চোরাই মালের কারবারের সাথে জড়িত পুরো চ্যানেলটি পুলিশে হাতে ধরা পড়তো।
যাই হোক, এই হল চোরাই কারবারের একটি নমুনা চিত্র। আজকে আমরা আলোচনা করবো চোরাই মাল রাখা বা ক্রয় সংক্রান্ত বিষয় এবং এর খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে।

 

আমাদের সমাজে চীনা মার্কেটের মতো যেকোনো পণ্যের কপি তৈরি না হলেও যেকোনো পণ্যের জন্য একাধিক টাইপের মার্কেট রয়েছে। বড় লোকদের জন্য বড় বড় শপিং মল, মধ্যবিত্তের জন্য সাধারণ মার্কেট আর নিম্নবিত্তের জন্য ফুটফাট। কিন্তু, সকল শ্রেণীর মধ্য থেকে কিছু লোকের জন্য রয়েছে চোরাইবাজার। এই চোরাই বাজের মোবাইল, জুতা থেকে শুরু করে অনেক আকর্ষণীয় জিনিস পাওয়া যায় স্বল্প মূল্য। সব জায়গায় যে আবার চোরাই বাজার থাকে তাও কিন্তু নয়, অনেক জায়গায় চোর নিজে হোম ডেলিভারিও দিয়ে থাকে। তো চলুন আজকে জানি এই চোরাইমাল গ্রহণ, রাখা এসবের শাস্তি সম্বন্ধে।

দণ্ডবিধির ৪১০ ধারায় চোরাই মালকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ৪১০ ধারা অনুযায়ী নিম্নলিখিত ৫টি উপায়ে কোন সম্পত্তির দখল হস্তান্তর বা গ্রহণ করা হলে, তাকে আমরা উক্ত সম্পত্তি চোরাই মাল বলে চিহ্নিত করবো।

  • প্রথমত, চুরি।
  • দ্বিতীয়ত, বলপূর্বক গ্রহণ।
  • তৃতীয়ত, দস্যুতা।
  • চতুর্থত, অপরাধমূলক আত্মসাৎ।
  • পঞ্চমত, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ।

উপরিউক্ত যেকোনো উপায়ে যদি কোন সম্পত্তির দখল হস্তান্তর বা গ্রহণ করা হয়, তাহলে উক্ত সম্পত্তির দখল গ্রহণ করাকে অসাধুভাবে চোরাইমাল গ্রহণ হিসেবে গণ্য করা হবে।
দণ্ডবিধির ৪১১ ধারায় অসাধুভাবে চোরাই মাল গ্রহণের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। অসাধুভাবে চোরাই মাল জানার পরও যদি কোন ব্যক্তি কোন চোরাইমাল অসাধুভাবে গ্রহণ করে বা দখলে রাখে, তখন উক্ত ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাবাস যা ৩ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
দণ্ডবিধির ৪১২ ধারায় ডাকাতি সংঘটনের সময় চুরিকৃত সম্পত্তি অসাধুভাবে গ্রহণের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। ডাকাতি সংঘটনের সময় চুরিকৃত সম্পত্তি অসাধুভাবে গ্রহণের শাস্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
দণ্ডবিধির ৪১৩ ধারায় অভ্যাসগতভাবে চোরাই মালের কারবার করার শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। অভ্যাসগতভাবে চোরাই মালের কারবার করার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডসহ।
দণ্ডবিধির ৪১৪ ধারায় অসাধুভাবে চোরাই মাল লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করার শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। চোরাই মাল লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করার শাস্তি হচ্ছে, যেকোনো বর্ণনার কারাবাস যা ৩ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে এবং অর্থদণ্ডসহ বা উভয় দণ্ড।

কিন্তু, চোরাইমাল চুরি কোন ক্রমে এর প্রকৃত মালিকের কাছে ফেরত চলে আসে বা দখলের অধিকারী ব্যক্তির নিকট চলে আসে, তাহলে উক্ত সম্পত্তি আর চোরাই মাল বলে গণ্য হবে না। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, প্রতারণা বা ডাকাতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি চোরাই মাল বলে গণ্য হবে না। সেটি কেন, তা নিয়ে অন্য আরেকটি আর্টিকেলে আলোচনা করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্‌।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.