তদন্ত রিপোর্টঃ চার্জশিট এবং ফাইনাল রিপোর্ট

ফৌজদারি আইন

একটি মামলা দায়ের করার পর আমরা তদন্ত রিপোর্ট, চার্জশিট এবং ফাইনাল রিপোর্ট এই শব্দগুলো প্রায় শুনে থাকি। কিন্তু এই শব্দগুলো দ্বারা আদৌতে কি বুঝায় সে সম্বন্ধে হয়ত আমাদের স্পষ্ট ধারনা নেই। তাই, আজকে আমরা তদন্ত রিপোর্ট, চার্জশিট এবং ফাইনাল রিপোর্ট, নারাজি ইত্যাদি সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই বলে রাখি, একটি মামলা দায়ের করার পর ওই মামলাতে বাদিপক্ষ অনেকগুলো অভিযোগ আনেন অভিযুক্ত বা আসামির বিরুদ্ধে। এখন ওই অভিযোগ গুলো সত্য না মিথ্যা সেই বিষয়টি আদালতের পক্ষে এজলাসে বসে জানা সম্ভব নয়। এখন অভিযোগগুলো সত্য না মিথ্যা এই বিষয়টি না জেনে বিচার কার্য পরিচালনা করাও সম্ভব নয়। তাই কোন মামলায় বাদি যখন কোন অভিযোগ আনেন আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে, তখন বাদির আনিত অভিযোগগুলো সত্য না মিথ্যা সেই বিষয়টি যাচাই করার জন্য উক্ত মামলার বিষয়বস্তুগুলোকে যে পরীক্ষা বা খোঁজ খবর নেওয়া হয়, তাকেই তদন্ত বলা হয়ে থাকে। আর এই তদন্ত করার দায়িত্ব সাধারণত পুলিশ তথা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর থাকে।

তারপরও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮ অনুযায়ী তদন্ত বলতে বুঝায়, সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোন পুলিশ অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অপর কোন ব্যক্তি (যিনি কিনা ম্যাজিস্ট্রেট নন) কর্তৃক পরিচালিত সকল কার্যক্রম। আবার পুলিশি তদন্ত বলতে বুঝায়, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোন পুলিশ অফিসার কর্তৃক পরিচালিত সকল কার্যক্রম।

তদন্তের সময় পুলিশ সাধারণত বাদির আনিত অভিযোগগুলো সত্য মিথ্যা যাচাই করে থাকেন। ওই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট যত জন রয়েছে, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকেন, সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে থাকেন, বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে আসামীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা সহ ইত্যাদি নানাবিধ উপায়ে তদন্ত করে থাকেন।

এখন তদন্ত যখন শেষ হয়, তখন কোন মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ যদি বাদির আনিত অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পায়, সেক্ষেত্রে যে রিপোর্টটি প্রদান করেন, তাকে বলা হয় চার্জশিট। আর যদি কোন মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ দেখতে পায় যে, বাদির আনিত অভিযোগগুলো সত্য নয়, সেক্ষেত্রে যে রিপোর্ট প্রদান করে, তাকে বলে ফাইনাল রিপোর্ট।

কোন মামলায় যদি তদন্ত শেষে পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়, সেক্ষেত্রে আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তি উক্ত মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকেন। কিন্তু বাদি মামলা করার পর যদি তদন্ত রিপোর্টে আসামীর বিরুদ্ধে কোনো সত্যতা না পাওয়া যায় তথা পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়, সেক্ষেত্রে বাদিপক্ষ চাইলে উক্ত ফাইনাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করতে পারে। সেক্ষেত্রে আদালত চাইলে অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দিতে পারে।

অন্যদিকে যদি কোন মামলার তদন্ত শেষে আসামির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য হিসেবে পুলিশ তথ্য পেয়ে থাকে, তখন পুলিশ চার্জশিট দিবেন এবং সেক্ষেত্রে তখন ওই চার্জের উপর ভিত্তি করে মামলার কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে।

এক কথায়, কোন অভিযোগ আসার পর পুলিশ তদন্ত শেষ করে ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ধারা ১৭৩ অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর যে রিপোর্ট পেশ করেন, তাকে পুলিশ রিপোর্ট বলে। এই রিপোর্ট সাধারণত দুই প্রকার, যথাঃ

১। চার্জশিট,

২। ফাইনাল রিপোর্ট।

 

চার্জশিটে যা যা থাকেঃ


চার্জশিটে সাধারণত মামলার নাম্বার এবং তারিখ, আইনের ধারা অর্থাৎ যে আইনের যে ধারায় বিচারের আবেদন করা হয়েছে এসব থাকে। তারপরে আসামিদের নাম, সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা, আসামিরা গ্রেপ্তার হলে বা পলাতক থাকলে তাদের নাম থাকে। যদি কোন সম্পত্তির চুরির মামলা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে চোরাই মালের বিবরণ দেওয়া থাকে। তাছাড়া, এই মামলায় যে আসামী, তার যদি পূর্বের কোন অপরাধের রেকর্ড থাকে, তাহলে সেটার বিবরণ। পাশাপাশি তদন্তের বিস্তারিত বর্ণনা উল্লেখ থাকে।

ফাইনাল রিপোর্টে যা যা থাকেঃ

ফাইনাল রিপোর্ট মূলত পাঁচ প্রকার। যথাঃ

  • প্রথমত, চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য, অর্থাৎ যখন এজাহারে বর্ণিত ঘটনা সত্য কিন্তু কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না, তখন তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন সেটি হচ্ছে চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য; ইংরেজিতে যাকে বলে FRT বা Final Report True.
  • দ্বিতীয়ত, চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা, অর্থাৎ তদন্তের পর যদি প্রমাণ হয় যে, ঘটনা মিথ্যা এবং হয়রানি মুলক সেক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিবেন, সেটি হচ্ছে চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা; ইংরেজিতে যাকে বলে FRF বা Final Report False.
  • তৃতীয়ত, চূড়ান্ত রিপোর্ট তথ্যগত ভুল, অর্থাৎ তদন্তের পর যদি দেখা যায় প্রাপ্ত ঘটনা এক প্রকার কিন্তু এজাহারে বর্ণিত ঘটনা অন্য প্রকার, সেক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিবেন সেটি হল চূড়ান্ত রিপোর্ট তথ্যগত ভুল; ইংরেজিতে যাকে বলে FRMF বা Final Report as Mistake of Fact.
  • চতুর্থত, চূড়ান্ত রিপোর্ট আইনগত ভুল, অর্থাৎ ঘটনা তদন্তের পর যদি দেখা যায় যে, যে আইনে এজাহার দায়ের করা হয়েছে মামলাটি সেই আইনে নয় বরং অন্য আইনে চলবে, সেক্ষেত্রে তখন তদন্তকারী কর্মকর্তা যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিবেন সেটি হল চূড়ান্ত রিপোর্ট আইনগত ভুল; ইংরেজিতে যাকে বলে FRML বা Final Report as Mistake of Law.
  • পঞ্চমত, চূড়ান্ত রিপোর্ট আমল অযোগ্য, অর্থাৎ তদন্তের পর যদি দেখা যায় যে, এজাহারে ঘটনার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে ঘটনা ততটা নয় বা যদি ঘটনা আংশিক প্রমাণিত হয় এবং ঘটনাটি এফআইআর যোগ্য না হয় তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের অনুমতিক্রমে নন এফআইআর প্রসিকিউশন রিপোর্ট দাখিল করবেন, যাকে বলা হয় চূড়ান্ত রিপোর্ট আমল অযোগ্য; ইংরেজিতে যাকে বলে FRN-Cog বা Final Report as Non-Cognizable.
close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.