ধর্ষণের শাস্তি

ধর্ষণের ধরণ ও শাস্তি

ফৌজদারি আইন

কেউ একজন বলেছিলেন যে, ধর্ষণের একমাত্র, কেবলমাত্র, শুধুমাত্র কারণটাই হচ্ছে, ‘পুরুষের পশুত্ব’। এর বাইরে ধর্ষণের জন্য আরো অন্য কোন কারণ থাকতে পারে না। নারীর পোশাক আর পুরুষের চোখের হেফাজত নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত শুধুমাত্র নিজের দোষটা আগে দেখবো না, সভ্যতা আর পশুত্বের মধ্যে পার্থক্য বুঝবো না, ততক্ষণ পর্যন্ত না নারীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, না ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব। নিম্নে আমরা ধর্ষণ নিয়ে আমাদের দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কি বলা হয়েছে সেটি নিয়ে আলোচনা করেছি।

ফ্যাক্ট ব্যাখ্যা শাস্তি আইন
যখন কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে যৌন সহবাস করে,

  • তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে
  • তার সম্মতি ছাড়া
  • তার সম্মতিতে কিন্তু সেই সম্মতি তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে আদায় করে নেওয়া
  • তার সম্মতিতে কিন্তু যখন ঐ নারী ঐ ব্যক্তিকে নিজের স্বামী বলে জানে কিন্তু ঐ পুরুষ জানে যে সে ঐ নারীর স্বামী নন
  • সম্মতি নিয়ে বা সম্মতি ছাড়া যেকোনো ১৪ বছরের কম বয়স্কার সাথে
এখানে ধর্ষণের জন্য ৫ টি উপাদান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, ইচ্ছার বিরুদ্ধে সহবাস করলে ধর্ষণ। দ্বিতীয়ত, সম্মতি ছাড়া সহবাস করলে ধর্ষণ। এখানে, ইচ্ছা বলতে নিজ থেকে সহবাস করার মানসিকতাকে বুঝানো হয়েছে, যেখানে সম্মতি বলতে সহবাস করার অনুমতি দেওয়া বুঝিয়েছে। তৃতীয়ত, মৃত্যু বা আঘাত করার ভয় দেখিয়ে সম্মতি নিলে সেটি সম্মতি হবে না। চতুর্থত, যদি কোন পুরুষ ব্যক্তির যেকোনো উপায়ে কোন স্ত্রী লোকের কাছে নিজেকে স্বামী পরিচয় দিয়ে সহবাস করে যদিও সেই ব্যক্তির ঐ মহিলার স্বামী নন এবং সেটা সে জানে কিন্তু ঐ মহিলা জানে না, তখন ঐ সহবাস ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। পঞ্চমত, ১৪ বছরের কম বয়সী যেকোনো নারীর সাথে সম্মতি নিয়ে হোক বা সম্মতি না নিয়ে হোক, যেকোনো ভাবে সহবাস করলেই সেটি ধর্ষণ হবে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড ধারা ৩৭৬, দণ্ডবিধি ১৮৬০
যখন স্বামী তার নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস করে কিন্তু স্ত্রী ১২ বছরের কম বয়স্ক এটাকে আইনের ভাষায় বলা হয় বৈবাহিক ধর্ষণ বা Marital Rape. নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাস করাও ধর্ষণ হতে পারে। এটা শুনতে অবাক হলেও আমাদের আইনেই, বয়সের ভিত্তিতে বৈবাহিক ধর্ষণ হতে পারে। দণ্ডবিধি অনুসারে নিজের স্ত্রীর বয়স ১২ বছরের কম হলে সেই স্ত্রীর সাথে তার সম্মতি নিয়ে সহবাস করলেও তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।

যদিও এই অংশটি এখন এক রকম অকার্যকর। কেননা, ১৮৬০ সালে বিয়ের জন্য মেয়েদের কোন বয়স সীমা না থাকলেও এখন কিন্তু মেয়েদের বিয়ের জন্য ১৮ বছরকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সুতরাং, এখন এই অর্থে বৈবাহিক ধর্ষণের সুযোগ নেই। তবে, বৈবাহিক ধর্ষণের আধুনিক যে ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সেটি কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক স্ত্রীর সাথে জোরপূর্বক ধর্ষণকে বুঝায়। সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত লিখবো। আজ কেবলমাত্র ধর্ষণ নিয়ে একটি মৌলিক ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। ধারা ৩৭৬, দণ্ডবিধি ১৮৬০
যখন কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সী কোন নারী বা শিশুকে

  • তার সম্মতি ব্যতিরেকে বা
  • ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করে

যৌন সঙ্গম করে,

এখানে ১৬ বছরের অধিক বয়সী যেকোনো নারী বা শিশুর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে সহবাস করলে ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। ধারা ৯(১); নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
যখন কোন পুরুষ ১৬ বছরের কম বয়সী কোন নারী বা শিশুকে

  • তার সম্মতি ব্যতিরেকে বা
  •  সম্মতি নিয়ে

যৌন সঙ্গম করে

এখানে ১৬ বছরের কম বয়সী নারী বা শিশুর সম্মতি নিয়ে হোক বা সম্মতি ছাড়া হোক, যেভাবেই সহবাস হোক তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। ধারা ৯(১); নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
যখন কোন ব্যক্তির কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণের ফলে বা ধর্ষণের পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ঐ নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, এই ধরনের ঘটনা আমরা প্রায়শই খবরে দেখে থাকি। ধর্ষণের পর খুন বা আঘাত, এখানে সেই বিষয়েই বলা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অন্যূন ১,০০,০০০/- টাকা অর্থদণ্ড। ধারা ৯(২); নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
যদি একাধিক ব্যক্তি নারী বা শিশুকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে সেই নারী বা শিশু আহত হোন বা মৃত্যু ঘটে এটা gang rape বা দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চলন্ত বাসে গণধর্ষণের খবর আমরা প্রায়ই দেখে থাকি, এটা সেই ক্যাটাগরির ধর্ষণ। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অন্যূন ১,০০,০০০/- টাকা অর্থদণ্ড। ধারা ৯(৩); নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
কোন ব্যক্তির যদি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন, এখানে ধর্ষণ নয় বরং ধর্ষণের চেষ্টা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অন্যূন ৫ বছর থেকে অনধিক ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। ধারা ৯(৪); নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
কোন ব্যক্তির যদি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু বা আহত করার চেষ্টা করেন, এখানে শুধু ধর্ষণ নয় বরং ধর্ষণের পরে মৃত্যু বা আহত করার চেষ্টা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। ধারা ৯(৪); নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
যদি কোন নারী পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে যে বা যারা ঐ নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরি দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন (তারা প্রত্যেকে ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হওয়া অবধি হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য) এখানে পুলিশ হেফাজতে অর্থাৎ থানা বা কারাগারে পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কোন নারীর ধর্ষণ হলে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অন্যূন ৫ বছর থেকে অনধিক ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অন্যূন ১০,০০০/- টাকা অর্থদণ্ড। ধারা ৯(৫); নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০

এখানে শুধুমাত্র আমরা ধর্ষণের মৌলিক ধারনা ব্যাখ্যাসহ শাস্তির পরিমাণ উল্লেখ করেছি। ভবিষ্যতে ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে সন্তান, বৈবাহিক ধর্ষণ, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ, ধর্ষণের মিথ্যা মামলা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লিখবো। আজ এই পর্যন্তই, ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.