আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হিসেবে পরিচিত। আদালতের সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করার জন্য এবং তদুপরি রাষ্ট্রের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য অবশ্যই আদালতের প্রতিটি সিদ্ধান্তকে সকলের দ্বারা মান্য করার জন্য এই আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আদালত অবমাননা কাকে বলে?
বাংলাদেশের আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, আদালত অবমাননা বলতে দুই ধরনের অবমাননাকে বোঝানো হয়: দেওয়ানী অবমাননা এবং ফৌজদারী অবমাননা। আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ২ ধারার অধীনে আদালত অবমাননার সংজ্ঞায় বলা হয় যে, “আদালত অবমাননা” বলতে দেওয়ানী বা ফৌজদারী অবমাননা বোঝানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আদালতের রায়, নির্দেশনা, আদেশ বা কার্যক্রমের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন বা সেই নির্দেশাবলী অমান্য করা।
দেওয়ানী অবমাননাঃ আদালত অবমাননা আইনের ২(৬) ধারায় “দেওয়ানী অবমাননা” বলতে বোঝানো হয়েছে, যখন কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতের রায়, ডিক্রী, নির্দেশনা, আদেশ, রীট বা কার্যক্রমের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেন অথবা আদালতের নিকট প্রদত্ত কোনো অঙ্গীকারনামা ভঙ্গ করেন।
উদাহরণস্বরূপ, ধরুন, একটি দেওয়ানী মামলায় আদালত একটি নির্দিষ্ট সম্পত্তি নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সম্পত্তিতে অনধিকার প্রবেশ করেন বা কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তাহলে সেটি দেওয়ানী অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে।
ফৌজদারী অবমাননাঃ আদালত অবমাননা আইনের ২(৮) ধারায় “ফৌজদারী অবমাননা” সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে মৌখিক, লিখিত বা চিহ্ন বা প্রদর্শনযোগ্য কোনো কিছুর মাধ্যমে আদালতের কর্তৃত্বকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়, বিচারিক কার্যধারায় হস্তক্ষেপ করা হয়, অথবা আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের স্বাভাবিক গতিধারাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়।
- (ক) আদালতের কর্তৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করা: এটি তখন ঘটে যখন কেউ আদালতের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে, যেমন, আদালত সম্পর্কে অপপ্রচার করা বা বিচারকের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য করা।
- (খ) বিচারিক কার্যধারায় হস্তক্ষেপ: যখন কোনো ব্যক্তি আদালতে চলমান বিচারিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেন, যেমন, সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো বা মিথ্যা তথ্য প্রদান।
- (গ) বিচারিক কার্যক্রমের স্বাভাবিক গতিধারাকে বাধাগ্রস্ত করা: এটি এমন পরিস্থিতিতে ঘটে, যখন কেউ আদালতে চলমান প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন বা প্রভাবিত করার অভিপ্রায়ে কোনো কার্যকলাপ করেন।
আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১৩ ধারাটি আদালত অবমাননার শাস্তি নির্ধারণ করে। বিচারব্যবস্থার সম্মান রক্ষার্থে এবং বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে সহায়তা করার জন্য এই আইনটি অত্যন্ত জরুরি। ১৩ ধারা আদালত অবমাননার বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
এই আর্টিকেলে আমরা আদালত অবমাননার শাস্তি, তার প্রভাব এবং ১৩ ধারার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবো।
- ১। আদালত অবমাননার শাস্তির পরিধিঃ আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১৩(১) ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি আদালত অবমাননার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তাকে অনূর্ধ্ব ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক দুই হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে। এটি আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট শাস্তি প্রদান করে, যা বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য অপরিহার্য।
- ২। ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগঃ আদালত অবমাননা আইনের ১৩(১) ধারা একটি শর্ত প্রদান করে, যেখানে অভিযুক্ত যদি আদালতের নিকট নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আদালত যদি এইমর্মে সন্তুষ্ট হন যে অভিযুক্ত সত্যিই অনুতপ্ত, তবে আদালত তাকে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারে। এটি আইনের মানবিক দিককে তুলে ধরে এবং বিচারে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
- ৩। আপিলের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনাঃ আদালত অবমাননা আইনের ১৩(২) ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি আদালত অবমাননার জন্য শাস্তি প্রাপ্ত হওয়ার পর আপিলে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আদালত যদি তার অনুতাপের প্রতি সন্তুষ্ট হন, তবে তাকে ক্ষমা করে দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস করা যেতে পারে। এটি আইনের একটি সহানুভূতিশীল দিক, যা অপরাধীকে তার ভুলের পর অনুশোচনা করার সুযোগ প্রদান করে।
- ৪। শাস্তির সীমাবদ্ধতাঃ আদালত অবমাননা আইনের ১৩(৩)(ক) ধারা অনুযায়ী, কোনো আদালত তার নিজের বা অধস্তন কোনো আদালতের অবমাননার জন্য উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত শাস্তির অতিরিক্ত শাস্তি প্রদান করতে পারে না। এর ফলে, বিচারকগণ আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শাস্তির সীমার মধ্যে থাকেন, যা বিচারব্যবস্থায় সামঞ্জস্য রক্ষা করে।
- ৫। দেওয়ানী অবমাননার ক্ষেত্রে শাস্তিঃ আদালত অবমাননা আইনের ১৩(৩)(খ) ধারা দেওয়ানী অবমাননার ক্ষেত্রে বিশেষ শর্ত প্রদান করে। যদি আদালত মনে করে যে শুধুমাত্র অর্থদণ্ড যথেষ্ট নয়, তবে তিনি অভিযুক্তকে অনূর্ধ্ব ছয় মাসের জন্য দেওয়ানী কারাগারে আটকের নির্দেশ দিতে পারেন। এটি বিশেষত সেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে কঠোর শাস্তির প্রয়োজন হয়।
আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান দেখানোর গুরুত্বের উপর জোর দেয়। বিচারকগণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন, আদালতের আদেশ মান্য করা অপরিহার্য এবং যারা এটি অমান্য করেন, তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার সুরক্ষা ও মর্যাদা বজায় থাকে।
আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১৩ ধারা বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি বিচারকের আদেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন নিশ্চিত করে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। আইনটি মানবিক দিকেও নজর দেয়, যেখানে অভিযুক্তের অনুতাপের ভিত্তিতে তাকে ক্ষমা করার সুযোগ প্রদান করা হয়। বিচারব্যবস্থার সম্মান এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য এই ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং আমরা সাধারণ জনগণ, আইনজীবী, মিডিয়া কর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে সবাই আইন আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )