সাধারণত এক পক্ষ আদালতে মামলা দায়ের করে, তারপরে অপরপক্ষকে আদালতে ডেকে পাঠানো হয়ে থাকে। আদালত তো আর আপনার আমার মতো না যে, মোবাইলে কল করে জানাবে বা বাড়িতে গিয়ে ডাক দিবে বা ধরে নিয়ে আসবে। আদালতে হাজির হওয়ার জন্য আদালত অপরপক্ষকে আদালতে সাধারণত সমন জারি করে থাকে। সমনে কোন আদালতে, কত তারিখে, কখন হাজির থাকতে হবে সে বিষয়ে লেখা থাকে। দেওয়ানী মামলায় সাধারণত বিবাদী পক্ষ বা সাক্ষী এবং ফৌজদারি মামলায় আসামী বা সাক্ষীকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়। সমন জারি করার পরও যদি কেউ আদালতে হাজির না হয়, সেক্ষেত্রে আদালত চাইলে ওয়ারেন্ট জারির মাধ্যমে গ্রেফতার করে উক্ত ব্যক্তিকে আদালতে উপস্থিত করতে পারবেন। ফৌজদারি কার্যবিধিতে ৬৮ থেকে ৭৪ ধারায় সমন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, অন্যদিকে দেওয়ানী কার্যবিধির ধারা ২৭ থেকে ৩২ সাথে আদেশ ৫ সমন নিয়ে আলোচনা করেছে। দেওয়ানী এবং ফৌজদারি উভয় মামলায় সমনের গুরুত্ব একই হলেও দেওয়ানী মামলায় সমনের কার্যক্রম অপেক্ষাকৃত বেশি।
দেওয়ানী মামলায় বিবাদীর প্রতি প্রথম সমন পাঠানো হয়, তার বিরুদ্ধে যে মোকদ্দমা দায়ের করা হয়েছে, সেই মোকদ্দমার আর্জির নকলসহ পাঠানো হয়। যেখানে সে তার বিরুদ্ধে কে মোকদ্দমা রুজু করেছে এবং কিসের মোকদ্দমা সেটাও জানতে পারে। দেওয়ানী মামলায় সমন জারি বাধ্যতামূলক আর মোকদ্দমা রুজুর ৫ কার্যদিবসের মধ্যে সমন ইস্যু করতে হয়, যা করতে ব্যর্থ হলে নিয়োগপ্রাপ্ত অফিসার অসদাচরণ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। আদালত চাইলে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বা ফ্যাক্সের মাধ্যমে অথবা ই-মেইলের মাধ্যমে সমন পাঠানোর আদেশ দিতে পারে। কোন কুরিয়ার সার্ভিস যদি ৩০ দিনের ভিতরে সমান পাঠাতে ব্যর্থ হয় তাহলে ওই কুরিয়ার সার্ভিসকে জেলা জজের কুরিয়ার সার্ভিসের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। যদি কোন ক্ষেত্রে বিবাদী বা সাক্ষী একাধিক হয় সে ক্ষেত্রে এক সমনের মধ্যে প্রত্যেকের নাম উল্লেখ না করে বরং প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা সমন জারি করা হবে। যেহেতু আমাদের দেশের মানুষ কোন নোটিশ গ্রহণ করতে ভয় পায় বা নিরুৎসাহিত হয়, তাই সমন গিয়েছে কিন্তু অনেকেই সমন পায়নি মর্মে মিথ্যাচার করে থাকে, তাই সমনের দুটো কপি নিয়ে যাওয়া হয়, যার উপর সমন জারি করা হয়েছে তাকে কপি দেওয়া হয় এবং আরেকটি কপির মধ্যে উনি যে পেয়েছেন সেই প্রাপ্তি স্বীকার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এখন কথা হচ্ছে কেউ যদি সমন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, এমন ঘটনা অহরহ। সাধারণত আমাদের দেশে দেখা যায় আদালত থেকে কোন কাগজ আসলে, এটা রিসিভ না করার মানসিকতা সবচেয়ে বেশি; এমনকি ডিভোর্স বা তালাক নোটিশ রিসিভ না করলে, ডিভোর্স হবে না এই একটা মানসিকতা আমাদের দেশে রয়েছে। রোগ হলে আমরা ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় পাই, ধরে নেই ডাক্তার টেস্ট দিলে তো রোগ বের হয়ে আসবে, তারচেয়ে ডাক্তারের কাছেও যাবো না, রোগও ধরা পড়বে না। আপনি ডাক্তার দেখান আর না দেখান, রোগ রোগের গতিতে ক্রমেই আপনার শরীরে বাসা বাঁধবে আর আপনাকে ধীরে ধীরে কাবু করবে। সমন বা যেকোনো ধরনের নোটিশ আসলে সেটা আপনি রিসিভ না করলেও সেটা তার নিয়মমাফিক কার্যক্রম চালিয়েই যাবে। যেখানে নোটিশ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি শুরু থেকেই বা সামান্য পর্যায় থেকেই আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন, গ্রেফতারের মত বিষয় এড়াতে পারেন; পাশাপাশি আমাদেরও জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে। কারণ আমরা যদি কোন সমন রিসিভ করতে না চাই অথবা যার নাম এসেছে তাকে যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, সে ক্ষেত্রে সে যেখানে বসবাস করে বা যেখানে তার ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে, সেখানে দেখা যায় এমন কোন জায়গায় সমনের একটা কপি ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। এখন আমরা যদি পণ্ডিতি করে সমন রিসিভ না করি আর তার ফলশ্রুতিতে আমাদের বাড়ির আশেপাশে বা আমাদের কর্মস্থলের আশেপাশে যদি এভাবে সমন ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তখন আমাদের আরো বেশি অসম্মান হলো না?- তাই এই ধরনের বিষয়গুলোকে অবজ্ঞা বা অবহেলা না করে বরং মোকাবেলা করা উচিত। এখন কোন বিবাদী বা সাক্ষী যদি দেশে না থাকে, বিদেশে থাকে সে ক্ষেত্রে সে বাংলাদেশের যে স্থানে বসবাস করত বা বাসস্থান, সেখানে পাঠিয়ে দিতে হবে আর কোন বিবাদী যদি কারাগারে অবস্থান করে অর্থাৎ বন্দি থাকে, সেক্ষেত্রে কারাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে সমন পাঠাতে হবে।
আমাদের যে তিন বাহিনী রয়েছে, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, তাদের কারো বিরুদ্ধে সমন পাঠাতে হলে সেক্ষেত্রে এক কপি তাদের কমান্ডিং অফিসার অধিনায়ক কর্মকর্তার নিকট জারির জন্য পাঠাতে হবে। তবে আদালত যদি কারো মর্যাদা বিবেচনা করে সমন না পাঠিয়ে তাকে পত্র প্রেরণ করে সে ক্ষেত্রে সেটি সমন হিসেবেই বিবেচিত হবে। এখানে অনেকেই অভিযোগ তুলেন যে, আইন সবার জন্য সমান নয় কেন, কাউকে সমন দিবেন আবার কাউকে চিঠি দিবেন। দেখুন এক শিক্ষক বা কোন বিষয়ে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিকে যদি কেবল সাক্ষী হিসেবে আদালত সমন পাঠায়, তাহলে আমাদের সমাজে এটার বিরূপ প্রভাব পড়বে কিনা, যেখানে চিঠি পাঠিয়ে ওনাকে আদালতে ওনার মূল্যবান সাক্ষ্য বা এক্সপার্ট মতামত দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। কখনো কখনো শুধুমাত্র দলীল উপস্থাপন করার জন্য সমন দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সমন দেওয়ার পরে কোন সাক্ষী যদি উপস্থিত না হয় বা সমন অমান্য করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়া যেতে পারে অথবা আদালত চাইলে সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিতে পারে। তবে তার আগে সাক্ষীর প্রতি হুলিয়া জারি করা হবে যদিও সাক্ষী হাজির হয়ে গেলে তখন আর থাকবে না, প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। মামলার পক্ষ বা সাক্ষী নয়, এমন কোন ব্যাক্তিকে আদালতের সমন জারি করে আদালতে উপস্থিত করতে পারেন। আমরা এক্সপার্ট অপিনিয়ন সম্বন্ধে একটু আগেই আলোচনা করলাম।
সবশেষে একটাই কথাই বলবো, সমন আসলে বা আপনার নামে সমন জারী করা হলে ভয় পেয়ে বোকামি করবেন না। ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু বোকামি করাটা অস্বাভাবিক। দেখতেই পারছেন, সমন গ্রহণ না করলে আপনার আশেপাশে ঝুলিয়ে দিবে বা টাঙ্গিয়ে দিবে, যেটা আরও অনেক মানুষ দেখবে তখন আপনারই সম্মানহানি হবে। তার উপর যদি আপনি আদালতের ডাকে সাড়া না দেন, তাহলে আদালত আপনাকে গ্রেফতার করে হলেও নিয়ে যাবে। তাহলে কেন শুধু শুধু পানি ঘোলা করা বলুন? বরং, ভদ্র সিভিলিয়ান হিসেবে আদালতকে সহযোগিতা করাই উত্তম। আপনার বিরুদ্ধে কেউ মামলা করা মানেই কিন্তু আপনি অপরাধী হয়ে গেলেন না কিন্তু। আপনাকে কেবলমাত্র অভিযোগ করা হয়েছে, অভিযোগ প্রমাণ না হলে আপনাকে অব্যাহতি দিতেই হবে; রয়েছে মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে প্রতিকার। তাহলে কেন শুধু শুধু উট পাখীর মত বালির মধ্যে মাথা ঘুচানো?
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )