একটা শান্ত এবং পড়ন্ত বিকেলের কথা। দিনের শেষ আলোটুকু যখন জানালার পর্দা ভেদ করে সাথীর ঘরে এসে পড়ছিল, ঠিক তখনই তার হোয়াটসঅ্যাপে অজানা এক নাম্বার থেকে একটি ‘হ্যালো’ ম্যাসেজ আসে। সাথী ফোন হাতে নিয়ে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। অচেনা নাম্বারটির পাশে নাম ছিল—রাজ। সাথী তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই না দিয়ে চুপচাপ ম্যাসেজটি শুধু দেখে রাখলো। কিছুক্ষণ পর আবারো ম্যাসেজ আসতে থাকে, “আপনি কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন?” সাথী তখনো নীরব থাকে। কিন্তু রাজ থেমে থাকার পাত্র ছিল না। বারবার ম্যাসেজ পাঠাতে থাকে সে। অবশেষে, বাধ্য হয়েই সাথী একটি ছোট জবাব দেয়—”কে আপনি?” এরপরই ধীরে ধীরে কথা বলা শুরু।
প্রথম দিকের ম্যাসেজগুলো ছিল খুব সাধারণ এবং ভদ্র। যেমন, শুভ সকাল, শুভ সন্ধ্যা, রাতের খাবার খেয়েছেন কি না, এমন সাধারণ কিছু প্রশ্ন। সাথী প্রাথমিক সৌজন্যবশত কিছু উত্তর দেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিতে থাকে। রাজ তার ম্যাসেজে ব্যক্তিগত তথ্য জানতে চাওয়া শুরু করে। সাথীর কাছে সেলফি চাইতে থাকে, বাসার ঠিকানা জানতে চায়। বিষয়গুলো ধীরে ধীরে অস্বস্তিকর এবং ভীতিকর হতে শুরু করে।
সাথী সিদ্ধান্ত নেয়, এই ম্যাসেজগুলোর কোনো উত্তর না দেওয়ার। সে ভেবেছিল এতে রাজ হয়তো হাল ছেড়ে দেবে। কিন্তু রাজ হাল ছাড়েনি, বরং আরও ভীতিকর এবং হুমকিমূলক বার্তা পাঠাতে শুরু করে। “তুমি আমার ম্যাসেজের উত্তর না দিলে তোমাদের বাসায় আমি আসবো। এতদিনের কথাবার্তার স্ক্রিনশট ফেসবুকে ছেড়ে দেবো!” এই ধরনের বার্তা দেখে সাথী ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে, বিষয়টি কেবল বিরক্তিকর নয়, ভয়ঙ্কর পর্যায়ে চলে গেছে।
সাথী এই পরিস্থিতিতে কী করবে বুঝতে পারছিল না। আতঙ্ক আর উদ্বেগে দিন কাটছিল তার। অবশেষে সে নিজের কিছু ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে বিষয়টি শেয়ার করে। বান্ধবীরা তাকে সাহস দেয় এবং পুলিশের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেয়। প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও পরে সাহস সঞ্চয় করে সাথী কয়েকজন বান্ধবীকে সাথে নিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করে। রাজের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিল পরিষ্কার, অনলাইনে হ্যারাসমেন্ট ও ভয় দেখানো। পুলিশের কাছে যথাযথ অভিযোগ করার মাধ্যমে সাথী বুঝিয়ে দেয়, নিরবতায় নয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয় সচেতনতার সাথে।
এবার আমরা আরেকটি ভিন্ন ঘটনার দিকে নজর দেই। ছোট্ট শহরের এক তরুণ, ইমরান। প্রযুক্তির প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ। সে ফেসবুকে মজার ভিডিও, ছবি এডিট করে আপলোড করতো এবং সেগুলো দ্রুত ভাইরাল হয়ে যেত। দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার লোভে সে একদিন একটি ভিডিও আপলোড করে, যা আসলে সরকারের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য বহন করছিল। ইমরানের ভিডিওটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। পুরো শহরে দ্রুতই একটি আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। সবাই ভাবতে থাকে সরকার তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠল। ঘটনাটি আর ছোট্ট শহরে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে লাগলো। অথচ ইমরান কিন্তু বিষয়টির ভয়াবহতা বুঝতেই পারেনি। সে ছুটছিল শুধু কিছু ভিউ আর ফলোয়ারের পিছনে। কিন্তু আইন তো অজ্ঞতাকে গ্রহণ করে না। ইমরান তার একটি ভুল পোস্টের কারণে জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তি বিঘ্নিত করেছে। অবশেষে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো।
এই ধরনের ঘটনাগুলো আজকাল আর বিরল নয়। আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটছে। সামাজিক মাধ্যম যেমন আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে কিছু দায়িত্বও। কিন্তু অনেক সময় আইনের ব্যাপারে অসচেতনতার কারণে আমরা নিজের অজান্তেই বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে যাই।
তো চলুন, জানি সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩: আক্রমণাত্মক বা মিথ্যা তথ্য অনলাইনে দিলে কী শাস্তি হতে পারে?
বর্তমান যুগে আমরা অনেকেই ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, টিকটক বা ব্লগে নিজের মতামত প্রকাশ করি, ভিডিও বানাই বা খবর শেয়ার করি। কিন্তু জানেন কি, অনলাইনে কি ধরনের তথ্য দিলে বা শেয়ার করলে সেটা আইনত অপরাধ হতে পারে?
সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৫ ঠিক এই বিষয়েই কথা বলে। তো চলুন আমরা ২৫ ধারা নিয়ে একটু আলোচনা করি।
সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৫ অনুযায়ী, কোন কোন কাজকে “অপরাধ” হিসেবে ধরা হয়?
এই আইনের আওতায় নিচের দুটি ধরণের কাজ করলে আপনি অপরাধ করছেন বলে ধরা হবে:
১. কাউকে হেয় করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা বা আক্রমণাত্মক কিছু অনলাইনে দেওয়া
যদি কেউ ইচ্ছে করে বা জেনেশুনে এমন কিছু পোস্ট বা শেয়ার করেন যা:
- কাউকে আক্রমণাত্মকভাবে অপমান করে
- ভয় পাইয়ে দেয় বা ভীতিকর কথা বলে
- বা আপনি জানেন তথ্যটি মিথ্যা, তবুও সেটা শেয়ার করেন
এবং এর মাধ্যমে কাউকে বিরক্ত, অপমান বা হেয় করার উদ্দেশ্য থাকে;
তাহলে এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
২. রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য ছড়ানো
যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্র বা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে—
- মিথ্যা তথ্য
- বা আংশিকভাবে বিকৃত তথ্য শেয়ার করেন বা ছড়িয়ে দেন;
তাহলেও তিনি এই আইনের আওতায় অপরাধী বলে গণ্য হবেন।
সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৫ অনুযায়ী অপরাধ করলে এর শাস্তি কী হতে পারে?
সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৫ অনুযায়ী অপরাধ করলে এর শাস্তি হতে পারে……
- সর্বোচ্চ ২ বছর জেল
- বা ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা,
- আবার কিছু ক্ষেত্রে উভয় দণ্ড-ও হতে পারে।
তাহলে কি বুঝলেন?
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই সচেতন থাকা আবশ্যক। নিজের অজান্তে বা জেনেশুনে এমন কোনো তথ্য শেয়ার করবেন না, যা আপনার বা অন্যের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। অবশেষে, সচেতনতাই হতে পারে এই ধরনের অপরাধ এড়ানোর প্রধান হাতিয়ার। মনে রাখা উচিত, ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের জন্য আমরা দায়বদ্ধ।
এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে এডভোকেট চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিকের তত্ত্বাবধানে একটি অনলাইন কোর্স করতে পারেন। কোর্সে অংশগ্রহণ করতে ভিজিট করুন: academy.legalfist.com অথবা যুক্ত থাকুন আমাদের WhatsApp গ্রুপেঃ https://chat.whatsapp.com/J0k8ORSPgLO7l08crSm9dA

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )