Presumption of innocence

ঘটনা সত্য তবে আসামী নির্দোষ

বিবিধ আইন

প্রায়শই আমরা কোর্ট প্রাঙ্গণে, সাংবাদিক মহলে বা আজকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো একটা কথা শুনে থাকি যে, ‘ঘটনা সত্য আসামী নির্দোষ’। এর দ্বারা কি বুঝায় এই নিয়েই প্রতিনিয়ত অনেকেই প্রশ্ন করতে থাকে। আজকে আমরা চেষ্টা করবো এই উক্তিটি দ্বারা আদৌতে কি বুঝায় সেটার গোঁড়ায় পৌঁছাতে।
একবার দুই চাপাবাজ বন্ধু একসাথে বসে চাপাবাজি করছিল। নিজেদের চাপার জোরে একে অন্যকে কাবু করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। প্রথম চাপাবাজ বন্ধু বলল যে, আমার দাদার এতো বড় গোয়ালঘর ছিল যে, গোয়াল ঘরের এক দিক দিয়ে একটি গরুর বাছুর প্রবেশ করে হেঁটে হেঁটে যদি গোয়ালঘরের শেষ প্রান্ত দিয়ে পৌঁছাত বা শেষ প্রান্তের দরজা দিয়ে বের হতো, তত দিনে গরুর বাছুরটি প্রাপ্তবয়স্ক গরু বা গাভীতে পরিণত হতো।
এটা শুনে দ্বিতীয় চাপবাজ বন্ধ অবাক হয়ে গেল। সে বলল, এত বড় গোয়ালঘর কিভাবে সম্ভব?
তখন প্রথম চাপাবাজ বন্ধু বলল, তুমি কি মনে করছো আমি তোমার সাথে মিথ্যে কথা বলছি। আমার দাদার আমলের গোয়ালঘর, নদীতে ভেঙে না গেলে এখনি তোমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাতাম।
তখন দ্বিতীয় চাপাবাজ বন্ধু একটু ভেবে চিন্তে বলল, আমার দাদারও একটা বিশাল বাঁশঝাড় ছিল। ওই বাঁশঝাড়ের বাঁশ গুলো এত বড়, এত লম্বা ছিল যে দাদা একটা বাঁশ বাড়িতে রাখতেন যেটা দিয়ে তিনি মাঝে মাঝে চাঁদের সামনে কোন মেঘ আসলে সেই মেঘকে ঠেলে সরিয়ে দিতেন।
এই শুনে তো প্রথম চাপাবাজ বন্ধু একেবারে হতবাক। সে বলে উঠলো, আমার সাথে চাপাবাজি হচ্ছে না? আচ্ছা শুনি, তোর দাদার যদি সত্যি এতো বড় বাঁশ থেকেই থাকতো, তাহলে সেই বাঁশ তিনি রাখতেন কোথায়?
তখন দ্বিতীয় চাপাবাজ বন্ধু উত্তর দিল, কেন, তোমার দাদার সেই গোয়ালঘরে। তোমার দাদা আর আমার দাদা বন্ধু ছিলেন না?

এখানে গল্পটা বলার মূল কারণ হচ্ছে, দুই বন্ধুই চাপাবাজ, সেক্ষেত্রে প্রথম বন্ধু নিরেট চাপাবাজ আর দ্বিতীয় বন্ধু প্রথম বন্ধুর চাপাবাজির সুযোগে কৌশল অবলম্বন করে নিজেও চাপাবাজি করেছিল। দুজনেই তাদের সময়কার গল্প না বলে তাদের অতীতের গল্প বলেছিল, যেটা প্রমাণ করার কোন সুযোগ নেই। এখন যদি সত্যিকার অর্থেও এমন কোন গোয়ালঘর থেকে থাকতো, সেটা কিন্তু প্রমাণ করার কোনও সুযোগ নেন৷ কারণ কোনো তথ্য উপাত্ত তাদের হাতে নেই। তাই, শুধু গল্প বা চাপাবাজি হিসেবে সেটিকে আপনি ধরে নিতে পারবেন, কখনোই সত্য ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করবেন না।
ঠিক তেমনি আপনি যদি একটি দেওয়ানি কিংবা ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন এবং সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি যদি কোনো তথ্য, উপাত্ত, সাক্ষ্য, প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারেন, সেক্ষেত্রে আপনার সেই মামলাটি ধোপে টিকবে না। অর্থাৎ আদালতে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না বা সোজা বাংলা কথায় আদালতের রায় আপনার পক্ষে যাবে না।
আমাদের দেশে অজস্র মামলা মোকদ্দমা রয়েছে যেগুলোর ঘটনা সত্য হওয়া সত্ত্বেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে, ন্যায়বিচার পাচ্ছে না বা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা জানি যে, আইনের চোখ অন্ধ। যার ফলে আইন সাক্ষীর কাছ থেকে শুনে বিচার করে থাকে। এখন সাক্ষী যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে ঘটনা সত্য হলেও আদালতের পক্ষে তথা আইনের পক্ষে সেটিকে সত্য ধরে নেওয়া সম্ভব নয়।
কেননা আজকে যদি একটি মামলা, মাত্র একটি মামলাও সাক্ষ্য প্রমাণের অনুপস্থিতিতে, অর্থাৎ আসামির বিরুদ্ধে কোন প্রকার সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই রায় প্রদান করা হয়, তাহলে কালকে সকল মানুষের বিরুদ্ধে সেটি একটি নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তখন সবাই কোন সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই মামলা দায়ের করবে এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে আসামি করে তার সাজার দাবি উত্থাপন করবে। তাই, সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকলে অপরাধ বা ঘটনা সত্য হলেও আসামীকে নির্দোষ ঘোষণা করতে হয়।
এমনকি, যদি কোন মামলায় আসামির বিরুদ্ধে যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো সন্দেহাতীতভাবে আসামিকে দোষী প্রমাণ করতে না পারে; অর্থাৎ একজন আসামীকে পরিপূর্ণভাবে আসামি প্রমাণ করতে যদি ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে সেই সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। সাক্ষ্য প্রমাণের মধ্যে যদি সামান্য সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে সেই সন্দেহের সুযোগ আসামির পক্ষে যাবে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, Benefits Of The Doubt Must Go To Accused (সন্দেহের সুফল অবশ্যই আসামিদের কাছে যেতে হবে)।

এবার আসুন, আদালতের নজীরের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি। রাষ্ট্র বনাম মোফাজ্জল হোসেন ১১ বিএলডি (এডি) ৩০৫ মামলায় আমরা দেখতে পাই যে, স্ত্রী হত্যা মামলায় স্বামীকে অভিযুক্ত করা হয়। স্বামী ৩৪২ ধারার জবানবন্দিতে দাবি করেন যে, তার স্ত্রী বিষ পান করে নিজে নিজেই আত্মহত্যা করেছে এবং স্ত্রী যেদিন আত্মহত্যা করেছে তার দুই দিন আগেই স্বামী তার নিজ নানাবাড়িতে ধান রোপণের কাজের জন্য চলে গিয়েছিলেন। যার ফলে এটা স্পষ্টত, ঘটনার দিন রাতে তিনি বাড়িতে ছিলেন না।
ঘটনার রাতে বা ঘটনার পূর্বে অভিযুক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ স্বামী স্ত্রী সাথে ছিল, এই ধরনের কোনও প্রমাণ প্রসিকিউশন করতে পারেনি। আবার ঘটনার পূর্বে বা পরে অভিযুক্ত ব্যক্তি ঘটনাস্থল ত্যাগ করছেন, এমনটাও প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। তাছাড়া, এমন কোন সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারেনি যে, ওই বাড়িতে স্ত্রীকে মারধর জনিত কোনও শব্দ শুনেছে। যার ফলে হাইকোর্ট বিভাগ মামলাটি সাক্ষ্য বিহীন মামলা হিসেবে উল্লেখ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ স্বামীকে খালাস প্রদান করে এবং আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের সেই আদেশ বহাল রাখেন।
এই মামলা থেকে আমরা এটি উপলব্ধি করতে পারি যে, প্রমাণ ব্যতিরেকে কোনও ঘটনায় আদালত বিবেচনা করতে পারে না। যদি ওই রাতে সত্যিকার অর্থে, আত্মহত্যা বা খুন বা অন্য যে কোন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ ঘটে থাকে এবং বাদী তথা প্রসিকিউশন যদি ওই ঘটনাটি প্রমাণ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে যদি ঘটনা সত্য হয়েও থাকে, আদালতের কিছু করার থাকছে না। কারণ আমরা জানি যে, একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করার পর সেটি পুলিশ তদন্ত করে থাকে। পুলিশ তদন্ত করে যদি সেখানে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ না পেয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে শুধু মাত্র সন্দেহের বশে কোন আসামীকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। এজন্য শুধু অভিযোগ করলেই হবে না, যথাযথ সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগটি প্রমাণও করতে হবে। অন্যথায় ঘটনা সত্য হলেও আসামী নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.