সাক্ষ্য আইন

সাক্ষ্য আইনে তৃতীয় পক্ষের অভিমত: পর্ব ০২

সাক্ষ্য আইন

একটা বাস্তব মামলা দিয়েই শুরু করা যাক। মামলার নাম্বার, পক্ষদ্বয়ের নাম এবং ঘটনাস্থল উহ্য রেখে মূল কেস স্টাডিটাই শেয়ার করি। একবার এক কনফেকশনারি অর্থাৎ মুদি দোকানদারের বিরুদ্ধে জাল নোট রাখার দায়ে মামলা হল। আপনি মামলার সাথে নিজেকে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে সম্পৃক্ত করতে আপনার আশেপাশের একজন মুদি দোকানদারকে কল্পনা করুন। আপনার আমার পরিচিত মুদি দোকানদাররা জাল নোটের ব্যবসা করে এমনটা ভাবতে একটু সঙ্কোচ হলেও একেবারেই যে সুযোগ বুঝে কিছু অবৈধ কাজে কেউ কেউ সম্পৃক্ত নেই, তা কিন্তু একেবারেই বলা যায় না। আবার, যদি কারো কাছে জাল নোট পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র জাল নোট বহনের মামলা কদাচিতই করা হয়, বেশীরভাগই জাল নোট বহর, সরবরাহ, এমনকি প্রস্ততকারক হিসেবেও মামলা খেয়ে (একটু আন-অফিশিয়াল হলেও এটাই মার্কেটে বেশি প্রচলিত) থাকে। তাই, ধরে নিন আপনার পরিচিত একজন মুদি দোকানদারকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হল তার কাছে জাল নোট থাকার দায়ে। যেহেতু এটা ফৌজদারি মামলা তাই রাষ্ট্র নিজে বাদী। এখন পাবলিক প্রসিকিউটর সাক্ষী হিসেবে রেখেছেন যে কাস্টমার বা খরিদদার তাকে এবং যে পুলিশ অফিসার তাকে ঐ জাল নোট সহ গ্রেফতার করেছে তাকে। এই দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রদানের ভিত্তিতে পাবলিক প্রসিকিউটর আদালতকে এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, মামলার বিষয়বস্তু অর্থাৎ জাল নোটগুলো দোকানদারের কাছে পাওয়া গেছে। কিন্তু, আসামী পক্ষের আইনজীবী অর্থাৎ দোকানদারের আইনজীবী উক্ত জাল নোট গুলো নিয়ে প্রথমে প্রসিকিউটর সাহেবকে পরে সাক্ষীদেরকে এবং সর্বশেষে স্বয়ং আদালতের হাতে দিয়ে প্রশ্ন করলো যে, ঐ নোট গুলো যে জাল নোট, সেটা প্রমাণ করতে। নোট গুলো দোকানদারের কাছে পাওয়া গেছে, এটা সত্য; এটাকে খণ্ডন করার কিছু নেই। কিন্তু, ঐ নোটগুলো যে জাল সেটা তো পাবলিক প্রসিকিউটর প্রমাণ করেননি। তখন, ঐ নোট গুলো যে জাল নোট সেটা conclusively প্রমাণ করতে রাষ্ট্র পক্ষ সমর্থ হয়নি। এমতাবস্থায়, প্রসিকিউটর নোট গুলো আসামীর কাছে পেয়েছে, এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হলেও নোট গুলো যে জাল সেটা প্রমাণ করতে পারেনি। জাল নোট প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত আপনি কখনোই আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারবেন না, কেননা বাংলাদেশের কোন আইনেই আপনি কোন নোট নিজের কাছে রাখার জন্য আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। তাই, আমাদের এই কেস স্টাডিতেও দোকানদার আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত না দোকানদারের কাছে প্রাপ্ত নোট গুলোকে জাল প্রমাণিত করা যায়।
অবশেষে, আদালতের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ ব্যাংকের জাল নোট বিষয়ে অভিজ্ঞ এখন অফিসারকে আদালতে তলব করা হল এবং পরবর্তীতে তিনি উক্ত নোট গুলো বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দেখে যাচাই বাছাই করে ওনার মতামত দিলেন এই বলে যে, নোট গুলো আসলেই জাল। তখন আসামী পক্ষের আইনজীবী বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐ অফিসারকে একটি প্রশ্ন করেছিল যে, এই নোট গুলো যে জাল নোট, সেটা আমাদের মত অনভিজ্ঞদের জন্য বুঝা কতটা সহজ বা স্বাভাবিক?



উত্তরে ব্যাংকের অফিসার বলেছিলেন যে, প্রতিনিয়তই জাল নোট প্রস্তুতকারীরা কৌশলগত দিক থেকে উন্নতি করছে, যার ফলে জাল নোট চেনা অনেকটা মুশকিল হয়ে পড়ছে যা খালি চোখে এবং অনভিজ্ঞ হাতে সত্যি শনাক্ত করা কঠিন।

এমতাবস্থায়, আসামী পক্ষের আইনজীবী খুব স্মার্টলি আর্গুমেন্টে বলেছিল যে, যেখানে পুলিশ এবং আমাদের মত আইনজীবীরা জাল নোট শনাক্ত করতে পারছি না, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষজ্ঞের সহায়তা প্রয়োজন হচ্ছে, সেখানে একজন মুদি দোকানদার শত ব্যস্ততার মাঝে এত টাকা পয়সা আদান প্রদানের ফাঁকে কীভাবে জাল নোট শনাক্ত করতে পারবে?
মামলার রায়ে কি হয়েছিল বা কেন হয়েছিল, সে সব নিয়ে কেস স্টাডি ক্যাটাগরিতে ভবিষ্যতে আলোচনা করবো। এতো লম্বা একটা আলোচনা করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, সাক্ষ্য আইনের ৪৫, ৪৬, ৪৭ ধারায় বারংবার বিভিন্ন ভাবে এটাই প্রতীয়মান করতে চেয়েছে যে, কোন বিষয়ে মামলার কোন পক্ষ না হয়েও কেবল তর্কিত বিষয়ে তার বিশদ জ্ঞান বা পারদর্শিতা থাকার ফলে তার মতামতকে তৃতীয় পক্ষের অভিমত হিসেবে গ্রহণ করে তর্কিত বিষয় নিষ্পত্তি করা।

বিভিন্ন সময় সিনেমাতেও দেখে থাকবেন যে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ডাক্তারদেরকে এক্সপার্ট অপিনিয়ন বা বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার জন্য আসতে দেখা যায়। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত বা কোন অসুস্থ ব্যক্তির মেডিকেল সার্টিফিকেট দেওয়ার পরও অনেক সময় সেই রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করতে ডাক্তার আদালতে আসতে হয়, সেটা কিন্তু ভিন্ন টপিক। এখানে আমরা আলোচনা করছি, ডাক্তারের সাথে যে মামলার কোন সম্পর্ক নেই, নেই কোন রিপোর্ট দেওয়া সংক্রান্ত সম্পর্কও; সেই ডাক্তারকে যখন কোন মামলায় ডাক্তারি শাস্ত্রের কোন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান রাখার জন্য বা কোন নতুন উদ্ভব সমস্যা সম্বন্ধে আদালতকে অবহিত করার জন্য ডাকা হয়, যার ফলে তিনি তার মূল্যবান অভিমত দিয়ে চলমান মামলা নিষ্পত্তি করতে সহায়তা করতে পারেন। যেমন, একজন ইন্টক্সিকেটেড বা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি দ্বারা কোন অপরাধ সংগঠিত হলে সেই পরিস্থিতিতে তার কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা বা কতোটা ছিল, এসব জানার জন্য। আবার, দেখবেন বিভিন্ন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীনে মামলা যেগুলো এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলো সম্বন্ধেও সাইবার সিকিউরিটি সম্বন্ধে যারা বেশি অভিজ্ঞ বা যথেষ্ট জ্ঞান রাখে তাদেরকে বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়ার জন্য আদালতে তলব করা হয়ে থাকে। কেননা, সাইবার আইন সম্বন্ধে আইনজীবীরা বেশ অভিজ্ঞ হলেও সাইবার সিকিউরিটির বিষয় গুলোতে কেবলমাত্র এই বিষয়ে যারা দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা বা বিশেষ জ্ঞান রাখেন, তারাই সঠিক মতামত দিতে পারেন। তাই, যেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানী বা অভিজ্ঞ মতামত ব্যতীত সঠিকভাবে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়, সেই সব বিষয়ে আদালতে তৃতীয় পক্ষের অভিমত প্রাসঙ্গিক হবে, অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য হবে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.