মৃত্যুকালীন ঘোষণা

সাক্ষ্য আইন

Dying Declaration বা মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলতে আপনার মাথায় প্রথমেই যে বিষয়টি মাথায় আসে, সেটি হচ্ছে বাংলা সিনেমার কোন দৃশ্য যেখানে কেউ একজন মারা যাওয়ার সময় তার হত্যাকারীর নাম বলে যাচ্ছে। সাধারণত, নায়কের বাবা বা মা মারা যাওয়ার সময় তার হত্যাকারীর নাম নায়কের কাছে বলে যায় আর নায়ক সেই হত্যাকারীকে খুন করে প্রতিশোধ নেয়; বেশির ভাগ বাংলা সিনেমার এই একই স্ক্রিপ্ট। তবে সহজ ভাষায় যেটা বুঝা যায় সেটি হচ্ছে, মৃত্যু কালীন সময়ে যে ঘোষণা দেওয়া হয়ে থাকে তাকেই মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলা হয়ে থাকে। আসুন জানি, Dying Declaration বা মৃত্যুকালীন ঘোষণা আসলেই এবং কিভাবে দেওয়া হয়ে থাকে।

প্রথমেই বলে রাখি, মৃত্যুকালীন ঘোষণা শুধুমাত্র ঘোষণা কারীর মৃত্যু সম্বন্ধীয় হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ বা যে সব অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটছে; কেবলমাত্র সে বিষয়েই মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করা যাবে। মৃত্যু সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করা যাবে না। যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তি তাঁর মৃত্যুশয্যায় যদি তাঁর সম্পত্তি কাউকে দান করতে চায়, সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা, আমরা জানি যে সম্পত্তি হস্তান্তর করার সময় একজন ব্যক্তিকে সজ্ঞানে প্রদান করতে হয়। কিন্তু কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর সময় পরিপূর্ণ জ্ঞান নাও থাকতে পারে। তাছাড়া শুধু মুখে বললেই সম্পত্তি প্রদান করা যায় না। সেটি অবশ্যই সাব রেজিস্টারের সামনে লিখিত হস্তান্তর হতে হবে। পাশাপাশি কেউ যদি পিতৃত্বের দাবি বা বৈবাহিক সম্বন্ধে কোনও বক্তব্য প্রদান করে সেটি মৃত্যুকালীন ঘোষণা হিসেবে গণ্য হবে না। শুধুমাত্র মৃত্যুর কারণ এবং মৃত্যু সম্পৃক্ত যে ঘটনাগুলো প্রাসঙ্গিক, সেগুলিই শুধুমাত্র মৃত্যুকালীন ঘোষণা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত্যুকালীন ঘোষণা কার কাছে দেওয়া যাবে বা কার বরাবরে ঘোষণা করলে সেটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? – এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, মৃত্যুকালীন ঘোষণা যেহেতু মৃত্যুর সময় ঘোষিত হয়ে থাকে এবং মৃত্যুর সময় যেহেতু uncertain বা অনিশ্চিত; সেহেতু মৃত্যুকালীন ঘোষণাও নির্দিষ্ট করে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট বা ডাক্তার এমন কারও কাছে প্রদান করতে হবে তার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। মৃত্যুকালীন ঘোষণা মৃত্যুর শয্যায় যেহেতু প্রদান করা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি যাকে সামনে পাবে তার কাছেই মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করতে পারবেন। যেমন, ধরুন কেউ যদি হাসপাতালে মাঝ রাতে মৃত্যুবরণ করেন এবং শেষ মুহূর্তে উনি হাসপাতালে থাকা কোনও নার্সের কাছে উনার মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করে গিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে সেই মৃত্যুকালীন ঘোষণা ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

এখন দেখা যাক, Dying Declaration বা মৃত্যুকালীন ঘোষণার প্রকৃতি কেমন হবে?
মৃত্যুকালীন ঘোষণা মৌখিক, লিখিত এমনকি ইশারায়ও হতে পারে। মৃত্যুর আগে আপনি কথা বলতে পারলে মৌখিক ভাবে আপনার মৃত্যুর কারণ বলে যেতে পারবেন। যদি কথা বলার মত পরিস্থিতিতে না থাকেন, তখন যদি লিখে বুঝিয়ে দিতে পারেন, তাহলে লিখিত ঘোষণাও মৃত্যুকালীন ঘোষণা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। তাছাড়াও, কখনো কখনো ভিকটিমের শারীরিক অবস্থা এমন হয় যে, না তিনি বলতে পারেন, না লিখতে, কিন্তু হয়ত শরীরের কোন অঙ্গ দ্বারা ইশারার মাধ্যমে বুঝাতে সক্ষম যে, ওনার মৃত্যুর কারণ কি বা কে ওনাকে আঘাত/খুন করেছে; সেক্ষেত্রে ইশারার মাধ্যমে প্রকাশ করাও মৃত্যুকালীন ঘোষণা হিসেবে গণ্য হবে।

এখন কথা হচ্ছে, কোনও ব্যক্তি যদি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুকালীন ঘোষণা দিয়ে থাকে, কিন্তু পরবর্তীতে উনি আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে মৃত্যুবরণ না করে থাকেন, সেই ক্ষেত্রে উনার ঐ মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না?– এই ক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ৩২ ধারা অনুসারে, মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদানকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই মৃত হতে হবে। যদি গুরুতর অবস্থা থেকেও কেউ আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে বেঁচে যান বা জীবিত থাকেন, সেক্ষেত্রে ওনার ওই মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
একই ভাবে, কোন ব্যক্তি যদি দাবি করে যে কোনো মৃত্যুশয্যায় থাকা ব্যক্তি/ ভিকটিম তার কাছে মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করেছেন, সেক্ষেত্রে দাবি উত্থাপনকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদানকারী ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। কোনও ব্যক্তি যদি নিরুদ্দেশ হয়ে যায় এবং অন্য কোনো ব্যক্তি যদি দাবি করে যে ওই ব্যক্তি মারা গেছে এবং সে মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করে গেছে সেই ক্ষেত্রে উক্ত দাবি উত্থাপনকারী ব্যক্তিকে প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে, মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদানকারী ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যথায় ওই মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কেননা মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণ করার পূর্বশর্ত হচ্ছে, উক্ত ঘোষণা প্রদানকারী ব্যক্তি মৃত হতে হবে।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখা হিমু সিরিজের একটি উপন্যাসে হিমুর মামা আততায়ীর হাতে যখন গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি থানায় গিয়ে মৃত্যুকালীন ঘোষণা হিসেবে নিজের কিছু চির শত্রুর নাম উল্লেখ করে দিয়ে আসেন। যদিও তিনি আঘাতকারীদের দেখতে পাননি, কিন্তু নিজের শত্রুদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে মৃত্যুকালীন ঘোষণাতে তাদের নাম উল্লেখ করে তাদেরকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেন। এটি উপন্যাসের একটি কাল্পনিক ঘটনা। কিন্তু বাস্তবেও যদি এমনটা ঘটে থাকে যে, কোনও ব্যক্তি মৃত্যুকালীন ঘোষণার সময় মিথ্যাভাবে অন্য কোনও ব্যক্তির নাম ঘোষণা করে, সেক্ষেত্রে ওই নির্দোষ লোক কি সাজা প্রাপ্ত হবে?–এই ক্ষেত্রে সাময়িক হয়রানি হলেও মাথায় রাখতে হবে যে, মৃত্যুকালীন ঘোষণা সাক্ষ্য হিসেবে প্রাসঙ্গিক। তবে সেটি কখনোই চূড়ান্ত প্রমাণ নয়; সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এটি মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে। আবার অনেক সময় মৃত্যুকালীন ঘোষণাও অসম্পূর্ণ থাকে, যার ফলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। তাই, মৃত্যুকালীন ঘোষণা অবশ্যই সম্পূর্ণ হতে হবে। অসম্পূর্ণ ঘোষণা হিতে-বিপরীত হতে পারে। আবার, মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করার পূর্বে ঘোষণাকারী কারো সাথে পরামর্শ করে ঘোষণা দিতে পারবেন না। আজকে এই পর্যন্তই, আল্লাহ হাফেজ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.