আবু উমামা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করে তার দরজায় একটি লেখা দেখতে পেল যে সদকার নেকি ১০ গুন বৃদ্ধি করা হয় এবং ঋণ দানের নেকি ১৮ গুন বৃদ্ধি করা হয়’। (সিলসিলা সহিহাহ, হাদিস: ৩৪০৭)। উপরের হাদিসটি পড়ার পর বা জানার পর আপনার কাছ থেকে আমি কিছু টাকা ঋণ চাইলাম, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আমি আপনাকে তা পরিশোধ করে দিব এই প্রতিশ্রুতিতে। আপনিও মনে মনে উপকার করতে পারার একটা আত্মতৃপ্তিতে আমাকে টাকাটা ঋণ হিসেবে দিলেন নির্দিষ্ট সময় পরে ফেরত পাবেন এই আশায়। কিন্তু, আমি সেই নির্দিষ্ট সময় পরে আপনার টাকা দেওয়া তো দূরের কথা উল্টো বিভিন্ন তালবাহানা শুরু করে দিয়েছি। কোথায় আপনি সওয়াবের আশায় আমাকে ঋণ দিলেন, সেখানে আপনি এখন আমার পিছনে পিছনে ছুটতে হচ্ছে পাওনা টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য আমাদের কাছে কোন ডকুমেন্ট থাকে না। আমরা এমন এক জাতি যারা কিনা কারো কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সময় লজ্জায় গণনা পর্যন্ত করি না, সেখানে টাকা ধার দেওয়ার সময় লিখিত কিছু নিবো সেটা তো লজ্জায় মাথা কেটে যাওয়ার মত অবস্থা। তাই, চাকরি দেওয়ার কথা বলে, বিদেশ নেওয়ার কথা বলে বা মামুলি যেকোনো কারণে টাকা ধার নিয়ে আর টাকা ফেরত না দিলে আমরা সেই টাকা আর সহজ উদ্ধার করতে পারি না। তাই, আমাদেরকে দ্বারস্থ হতে হয়, তৃতীয় কোন পক্ষের কাছে যারা কিনা উদ্ধারকৃত টাকা থেকে একটা অংশ আবার কেটে রেখে দিবে এই চুক্তিতে টাকা উদ্ধার করে দেয়। ওরা কারা, সেটা লেখাটাই বাহুল্য।
যাই হোক, পাওনা টাকা আদায় করতে হলে যেহেতু সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন সেহেতু আপনি শুরুতে যদি কোন সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে না থাকেন, তাহলে পরবর্তীকে যদি কোন চুক্তিপত্র করে নিতে পারেন, তাহলে অবশ্যই সেটি করে নিবেন। আর যদি দেনদার ধূর্ত হয়, তাহলে আপনাকে চালাকি অবলম্বন করতে হবে। মোবাইল কল রেকর্ড করে বা ইমেইল বা ম্যাসেজে তার টাকা ধার নেওয়ার বিষয়টি স্বীকারোক্তি নিতে পারলে তখন একটি ব্যবস্থা করা যেতে পারে। (মোবাইলের মাধ্যমে টাকা ধার নেওয়ার স্বীকারোক্তি কিভাবে নিতে পারেন, সেটি নিয়ে আরেকদিন লিখবো)।
এবার কথা হচ্ছে, কি ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবেন?
দেওয়ানী আদালতে পাওনা টাকা ফেরত পেতে আপনাকে মানি স্যুট বা অর্থের মামলা করতে হবে। অন্যদিকে ফৌজদারি আদালতে করতে হবে প্রতারণা এবং অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের মামলা। মামলা করলেই টাকা ফেরত পাবেন, তা কিন্তু নয়। যথাযথ সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে না পারলে, মামলা খারিজ হয়ে যাবে। তাই, আগে মাথায় রাখতে হবে টাকা ধার দেওয়া সময় আপনার করণীয় কি। কথায় আছে না, Prevention is better than cure.
আসুন জেনে নেই, টাকা ধার দেওয়ার সময় আপনার কি কি করণীয়:
- ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পে একটি চুক্তি করে নিবেন। (চুক্তিপত্র কিভাবে করবেন সেটি নিয়ে আরেকদিন ষ্ট্যাম্পের নমুনা সহ লিখবো। আমাদের ওয়েবসাইটে চোখ রাখুন)।
- টাকার পরিমাণ স্পষ্টত উল্লেখ করুন এবং কবে ফেরত দিবে সেটিও স্পষ্ট করুন। টাকা ফেরত দেওয়ার পদ্ধতিটি কি সেটিও পরিষ্কার উল্লেখ করুন চুক্তিপত্রে। যেমন, টাকাটা কি একসাথে দিবে নাকি ভেঙ্গে ভেঙ্গে কিস্তিতে দিবে, সেটি উল্লেখ করে রাখবেন। তারপর টাকা কি হাতে হাতে নগদ দিবে নাকি ব্যাংকের মাধ্যমে দিবে(কোন একাউন্টের দিবে সেটাও পরিষ্কার করবেন) সেটিও নিজেদের মাঝে সমঝোতার মাধ্যমে চুক্তিপত্রে উল্লেখ করবেন।
- তারপর যদি সময়মত আপনার টাকা ফেরত না দেয় বা চুক্তির কোন শর্ত ভঙ্গ করে, তবে আপনি কি ধরনের আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবেন, সেটিও লিখে রাখবেন। যেমন, আপনি কি স্থানীয় বা নিজেদের মনোনীত সালিশের মাধ্যমে সমঝোতা করবেন নাকি থানায় অভিযোগ করবেন নাকি সরাসরি আদালতে গিয়ে দেওয়ানী বা ফৌজদারি মামলা দায়ের করবেন, সেটিও চুক্তিপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ রাখবেন।
- চুক্তিটি সম্পাদনের সময় অবশ্যই উভয় পক্ষের সাক্ষীর উপস্থিতিতে সম্পাদন করবেন। সাক্ষীদের স্বাক্ষর অবশ্যই রাখবেন যাতে ভবিষ্যতে এই চুক্তিপত্র নিয়ে কোন জটিলতা সৃষ্টি হলে যাতে তারা ঐ চুক্তিপত্রর বৈধতা নিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে। তাছাড়া, চুক্তির বিষয়ে কোন জটিলতা সৃষ্টি হলেও যাতে তারা প্রাথমিক সমাধান দিতে পারেন, সেই চেষ্টাও করতে পারবেন।
- চুক্তিপত্রটি নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বা ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সত্যায়িত করে রাখবেন, এতে যেমন চুক্তিটি আইনি ভিত্তি পাবে তেমনি চুক্তি ভঙ্গের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা পাওয়াও সহজ হবে।
- চুক্তিপত্রের সাথে যাকে টাকা ধার দিবেন, সম্ভব হলে তার কাছ থেকে তার ব্যাংক একাউন্ট থেকে চেক নিয়ে রাখবেন। চেকে তার স্বাক্ষর আর টাকার অংক লিখিয়ে নিলেও তারিখ বসাবেন না। কেননা, চেকের মেয়াদ থাকে চেকে উল্লেখিত তারিখ থেকে পরবর্তী ৬ মাস। চেক থাকলে আপনার টাকা উদ্ধারে হয়রানী আরও কমে যাবে। কেননা, চেক ডিসঅনারের মামলা খুব দ্রুতই নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং আসামীকেও গ্রেফতার করা হয় অতি শীঘ্রই। চেক ডিসঅনার নিয়ে বিস্তারিতভাবে আরেকদিন লিখবো।
আমরা যারা টাকা ধার নিয়ে ফেরত দেই না বা দিতে ইচ্ছুক নই, তাদের জন্য দুটো কথা। আমরা যারা মনে করি যে, কারো টাকা মেরে দিয়ে গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকলে একসময় আর পরিশোধ করা লাগবে না বা শুদ্ধ ভাষায়, কারো কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেটি পরিশোধ না করে কোন ভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলে কে আর কি করবে? মরে গেলে কি আর টাকা পরিশোধ করতে হবে?- তাহলে শুনুন, ঋণগ্রস্ত হয়ে মারা গেলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা:) মৃত ব্যক্তির সম্পদ তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টনের আগে মৃতের ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছেন। কেননা, আল্লাহ্র পথে শহীদ হওয়া ব্যক্তিও তার ঋণের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২২৪৯৩)। মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। মরে গেলে আপনার শরীর পচে যাবে, কিন্তু আত্মা বিচার থেকে মাফ পাবে না। তাই, যাদের এই অভ্যাসটি রয়েছে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করা, তাদের উচিত দুনিয়াতে থাকতেই তাদের অভ্যাস বদলানো। কেননা, অঙ্গীকার করে পরে সেটা অস্বীকার করা মনুষ্যত্বের মাঝে পড়ে না।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )