গত দুই পর্বে আমরা দেখেছিলাম যে তালাক নোটিশ পাঠানোর পর যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা হয়ে যায়, তখন উক্ত তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করা সম্ভব। একই ভাবে গর্ভবতী স্ত্রীকে তালাক নোটিশ পাঠানোর পর সেটির কার্যকারিতা এবং তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করতে পারা প্রসঙ্গে। আজকে আমরা দেখব তালাক নোটিশ প্রত্যাহার প্রসঙ্গে।
স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি তার স্ত্রী বা স্বামীকে তালাক দিতে চাই, সেক্ষেত্রে প্রথমত যাকে তালাক দিবে তার ঠিকানা বরাবর নোটিশ পাঠাতে হবে এবং আরেকটি নোটিশ সালিশি পরিষদে পাঠাতে হবে। সালিশি পরিষদ বলতে ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বা মেয়র বরাবর তালাক নোটিশের একটি কপি পাঠাতে হবে।
সাধারণত এই তালাক নোটিশ সালিশি পরিষদে পাঠানোর পর সালিশি পরিষদ থেকে তালাক ঠেকানোর জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা করার চেষ্টা চালানো হয়ে থাকে। সেই জন্য আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সালিশি পরিষদ তালাক নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করব। উভয় পক্ষ উক্ত সময়ের মধ্যে নিজেরাও সমঝোতা করার চেষ্টা চালাতে পারে।
উক্ত ৯০ দিনের মধ্যে যদি পারস্পরিক সমঝোতা না হয়, সেক্ষেত্রে ৯০ দিন পর আপনাআপনি তালাক কার্যকর হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে তালাক নোটিশ পাঠালে অনেকেই তালাক নোটিশ গ্রহণ করতে চায় না। আবার অনেকেই আছে তালাকের নোটিশটি চালাকি করে ভুল ঠিকানায় পাঠায় বা নোটিশ পাঠালেও প্রাপক যাতে না পায়, সেই ব্যবস্থা করিয়ে নেয়।
তাই, তালাক নোটিশের একটি কপি সালিশি পরিষদেও পাঠাতে হয়। সালিশি পরিষদে যে পক্ষই যেকোনো ধরনের নোটিশ পাঠালে সেটি সালিশি পরিষদ গ্রহণ করবে। সালিশি পরিষদ যে দিন নোটিশ গ্রহণ করবে, সে দিন থেকে ৯০ দিন গণনা শুরু হবে।
এখন আমাদের সমাজে বেশিরভাগ তালাকের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি দেখা যায় সেটি হচ্ছে, রাগের মাথায় বা ভুল বোঝাবুঝি (যদিও সাম্প্রতিক সময়ে পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা, শারীরিক সমস্যা বা মানসিক দূরত্ব)।
রাগের মাথায় মুখে তালাক দেওয়ার বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে বলে এখন কেউ মুখে তালাক না দিলেও নোটিশ তৈরি করতে বেশি সময় লাগে না। বেশিরভাগ সময় রক্ত গরম থাকতে থাকতেই তালাক নোটিশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু দু’একদিনের মধ্যেই রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলে তখন অনেকেই বুঝতে পারে যে, সে ভুল করেছে। যে সমস্যাটি তাদের মধ্যে বিদ্যমান, সে সমস্যাটির সমাধান ডিভোর্স বা তালাক নয়।
আবার অনেকেই আছেন, সন্তানের কথা চিন্তা করে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদকে এড়াতে চায়। তাছাড়া, পারিবারিক কারণেই হোক, ব্যক্তিগত কারণেই হোক বা সন্তানদের প্রচেষ্টায় বা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন, যখন কোনও দম্পতির যে কোন একজন তালাক নোটিশ পাঠিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সেই তালাক নোটিশ সালিশ পরিষদ ৯০ দিনের মধ্যে যদি সমঝোতা করতে পারে সেক্ষেত্রে তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করার মাধ্যমে ওনারা পুনরায় সংসার করতে পারবেন। এখন তালাক নোটিশটি প্রত্যাহার কীভাবে করতে হবে?
তালাক নোটিশ কিভাবে প্রত্যাহার করতে হবে তা আইনে নির্দিষ্ট কোনো ফরম্যাটে বলা নেই। যার ফলে আপনি যেভাবেই তালাক নোটিশ ফরম্যাটে লিখেছেন, ঐ ফরম্যাটেই তালাক প্রত্যাহারের একটি দরখাস্ত লিখে সালিশি পরিষদে জমা দিয়ে আসতে পারেন এবং প্রাপ্তি স্বীকার সংক্রান্ত একটি কপি নিয়ে আসতে পারেন। মূল কথা, সালিশি পরিষদকে নিশ্চয়তা দেওয়া যে, আপনাদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা হয়েছে এবং আপনারা পুনরায় সংসার করতে যাচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে এই যে, সালিশি পরিষদ থেকে তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করা এতো প্রয়োজনীয় কেন?
তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করার প্রয়োজনীয়তা জানতে হলে একটি ঘটনা বলতে হবে। ঘটনাটি সত্য, তবে নিম্নে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
সিয়াম একজন প্রবাসী এবং সুমির সাথে তার তিন বছরের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু, পরকীয়ার অভিযোগে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ তৈরি হয় এবং সেই অনুযায়ী সুমি সিয়ামের ঠিকানায় তালাক নোটিশ পাঠায়। তালাক নোটিশ পাঠানোর পর বিভিন্ন ভাবে যুক্তি তর্ক প্রমাণ উপস্থাপনের পর ধীরে ধীরে বরফ গলতে থাকে এবং পুনরায় সুমি সিয়ামের সাথে সংসার করার ইচ্ছা পোষণ করে।
সে অনুযায়ী কিছু দিন পর মান অভিমান ভুলে তারা এক সাথে থাকতে শুরু করে। দাম্পত্য জীবনের সাথে থাকা মানে হচ্ছে, মানসিক, শারীরিক সব ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করে। কিছুদিন পর সিয়াম প্রবাসে চলে যায় এবং কিছু দিন সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু, সুমি কয়েক মাস পর হুট করে একটি ছেলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সিয়াম তো আকাশ থেকে পড়লো, সে সাথে সাথে দেশে ফিরে আসলো এবং সুমির বাড়িতে গিয়ে সুমির সাথে ঐ ছেলেকে হাতে নাতে ধরলো।
সুমি তখন সিয়ামকে জানালো তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন সে বর্তমানে রিফাত নামের এই ছেলেকে বৈধ ভাবে বিবাহ করেছে। সিয়াম বুঝে উঠতে পারল না তাদের কিভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হল।
তারপর খোঁজখবর নিয়ে জানা গেলো যে, সিয়াম এবং সুমির মধ্যে প্রথম কলহের কারণে তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিনের মধ্যেই তারা পারস্পরিক সমঝোতা করে একসাথে বসবাস করা শুরু করলেও সালিশি পরিষদ থেকে তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করা হয় নি। সালিশ পরিষদের পক্ষে আপনাআপনি জানা সম্ভব না যে, কারো তালাক নোটিশ পাঠানোর পর সমঝোতা হয়েছে।
আর সুমি এই সুযোগটিই নিয়েছে; তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরে তালাক যেহেতু আপনাআপনি কার্যকর হয়ে যায়, তাই সুমি সেই সুযোগটি নিয়ে ৯০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর তালাক রেজিস্ট্রেশন করিয়ে পরবর্তীতে রিফাতের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এটি অন্যায় এবং শুনতে খারাপ লাগলেও আইনত সুমির অন্যত্র বিবাহ করতে কোনও বাধা রইল না।
যার ফলে এই ধরণের অনেক ঘটনা এখন দেখতে এবং শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। তাই তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে যদি সমঝোতা হয়ে যায়, তাহলে অবশ্যই সালিশি পরিষদকে লিখিত ভাবে জানাতে হবে; যাতে নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরে আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী এসে সালিশি পরিষদ থেকে সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আপনার দাম্পত্য বা সংসার বা জীবনকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে আপনাকে ঠকাতে না পারে। আশা করি, তালাক নোটিশ প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আর কোন সংশয় থাকবে না।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )