কাবিননামায় কুমারী শব্দ

কাবিননামায় কুমারীর পরিবর্তে লিখতে হবে অবিবাহিত

পারিবারিক আইন

কুমারী শব্দের অর্থ হচ্ছে অনূঢ়া অর্থাৎ অবিবাহিতা কন্যা। কিন্তু অবিবাহিতা কন্যা বুঝালেই এতে কোন আপত্তি থাকতো না, আপত্তি হচ্ছে কুমারী শব্দের আড়ালে নারীর চরিত্রকেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়। কোন মেয়ে কুমারী বলতে তাকে বিশুদ্ধ বা সতী বা আরও সোজাসাপ্টা ভাষা বললে অক্ষতযোনি বা যৌনসঙ্গমের অনভিজ্ঞ স্ত্রীলোককে বুঝানো হয়; যাকে ইংরেজিতে Virgin বা ভার্জিন বলা হয়ে থাকে।
এখন কোন স্ত্রীলোক কুমারী কিনা সেটি যেভাবে নির্ধারণ করা হয়, তাকে বলে কুমারীত্ব পরীক্ষা। কোন নারী কখনো যৌন মিলনে লিপ্ত হয়েছে কি হয়নি, সেটি এই কুমারীত্ব পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অতীতে ধর্ষণের মামলাতে ধর্ষণ হয়েছে কিনা সেটি টেস্ট করার জন্য কুমারীত্ব পরীক্ষা করা হতো, যা কিনা ‘দুই আঙুলের পরীক্ষা’ নামে পরিচিত, যা কিনা যথেষ্ট অবৈজ্ঞানিক।
সবচেয়ে আতঙ্কের এবং একইসাথে দুর্ভাগ্যজনক যে, কুমারীত্ব পরীক্ষার নামে অনুমানের ভিত্তিতে একজন স্ত্রীলোকের অক্ষত যোনিচ্ছদের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে, যা কিনা একজন নারীর প্রতি অপমানজনক, বেদনাদায়ক এবং পীড়াদায়কও বটে। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, কুমারীত্ব পরীক্ষার নামে যে পরীক্ষা মূলত চালানো হয় অর্থাৎ যোনি শিথিলতা এবং সতীচ্ছেদের অনুপস্থিতি উভয়ই কারণ শুধুমাত্র যৌন মিলন নয়, আরও অনেক ধরনের কারণেও হতে পারে। তাই, কুমারীত্ব পরীক্ষার নামে একজন নারীকে অপমান, অপবাদ এবং অবজ্ঞাই করা হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে, ২০১৮ তে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদসহ জাতিসংঘেরই নারী সংগঠন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কুমারীত্ব পরীক্ষা প্রথা বন্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।

 

কাবিননামাতে একজন নারী কুমারী কিনা জানতে চাওয়া নারীকে অপমানজনক নয় কি?
মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ এর বিধি ২৮ (১) (ক) অনুযায়ী বিবাহ ফরমের ৫ নাম্বার কলামে জানতে চাওয়া হয় যে, কন্যা কুমারী, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কি না?
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কাবিননামায় কুমারী হিসেবে যদি কোন কণে উল্লেখ করে যে সে কুমারী, সেটি সত্য মিথ্যা যাচাই করার কোন সুযোগ যেমন নেই, তেমনি যাচাই করার প্রচলনও নেই, তখন শুধু শুধু এই কলামটি রাখারই বা কি দরকার। কণের কুমারী শব্দে হয়ত আপত্তি থাকতো না যদি বরের ক্ষেত্রে কুমার শব্দটি ব্যবহার করা হতো। বরের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন শব্দ ব্যবহার করা হয়নি কাবিননামা বা নিকাহনামাতে; যা কিনা আমাদের সংবিধান অনুযায়ী নারী পুরুষের সমতার পরিপন্থী।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ এর বিধি ২৮ (১) (ক) অনুযায়ী বিবাহ ফরমে, কন্যার ক্ষেত্রে কুমারী, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কিনা জানতে চাওয়া হয়েছে, অথচ পুরুষের ক্ষেত্রে সে কুমার বা বিপত্নীক বা তালাক প্রাপ্ত কিনা সেটি জানতে চাওয়া হয়নি। একজন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ হিসেবে আমাদের প্রথম দেখাতেই কি মনে হয় না যে, এটি নারীর প্রতি অবজ্ঞা, রীতিমত বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতমূলক?

১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ইং তারিখে হাইকোর্ট বিভাগে ‘কাবিননামা সংশোধন’ সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলা (রীট পিটিশন নং – ৭৮৭৮/২০১৪) দায়ের করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ গত ১৭ নভেম্বর ২০২২ তারিখে রায় প্রকাশ করেন। উক্ত রায়ে, ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ এর বিধি ২৮ (১) (ক) অনুযায়ী বিবাহ ফরম তথা কাবিননামার ফরম থেকে ‘কুমারী’ শব্দ বাদ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। শুধু তাই নয়, কুমারী শব্দ বাদ দেওয়ার পাশাপাশি কাবিননামায় পুরুষের বর্তমান বৈবাহিক অবস্থা উল্লেখ করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

জনস্বার্থ মামলার (রীট পিটিশন নং- ৭৮৭৮/২০১৪) রায়ে আরও বলা হয়েছে, কাবিননামা বা নিকাহনামার ২১ ও ২২ নম্বর কলামে বরের বর্তমানে কোনো বিবাহ বলবৎ আছে কি না, শুধু সে সম্পর্কিত তথ্যাদি জানতে চাওয়া হয়েছে। অথচ, বর নিজে তালাকপ্রাপ্ত বা বিপত্নীক (স্ত্রী মারা গেছে) অথবা কুমার কি না, এ সম্পর্কিত তথ্যাদি জানতে চাওয়া হয় নি। অন্য দিকে, কাবিননামা বা নিকাহনামার বিতর্কিত ৫ নং কলামে কন্যা তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা কি না, এ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে যা অপমানজনক, বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট এবং সিডও সনদসহ সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩১ নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও পরিপন্থী। অবিবাহিত শব্দের পরিবর্তে কুমারী শব্দের প্রয়োগ নারীর জন্য অমর্যাদাকর ও অপমানজনক যা সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদ এবং সিডও সনদের লঙ্ঘন।

বিবাহের ক্ষেত্রে শুধু দু’টি মানুষ এক সাথ হয় না, দু’টি পরিবার, দু’টি সমাজও এক সাথ হয়। আর বিবাহ যেহেতু একটি সামাজিক চুক্তি, তাই সে চুক্তিতে অবশ্যই দুইজনের প্রতি দুইজনের সমান সম্মান এবং মর্যাদা প্রদর্শন জরুরী। একজনের গোপনীয়তা জানতে চাওয়া হবে কিন্তু আরেকজনের কিছুই জানা হবে না যেমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তেমনি যেকোনো একজনের গোপনীয়তা জানতে চাওয়াও অমানবিক। তাই, দুইজনেরই গোপনীয়তা জানতে চাওয়ার চেয়ে কারো গোপনীয়তা জানতে না চাওয়াই উত্তম। আবার, কুমারী পরীক্ষা যেহেতু অতিমাত্রায় অবৈজ্ঞানিক, বিতর্কিত প্রাচীন প্রচলন, নারীর প্রতি অবজ্ঞা, সেহেতু যথাসম্ভব এই ধরনের বিতর্কিত বিষয়গুলো আজকের দিনে বাদ দেওয়াই শ্রেয়।
ইনশাআল্লাহ্‌, রায় কার্যকর হলে আমরা মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ এর বিধি ২৮ (১) (ক) অনুযায়ী বিবাহ ফরমের ৫ নং কলামে ‘কুমারী’ শব্দের পরিবর্তে ‘অবিবাহিত’ শব্দটি দেখতে পাবো। এভাবেই একে একে সব ধরনের অসামঞ্জস্যতা, নারী পুরুষের অসমতা, সংবিধান পরিপন্থী বিধান গুলো বাতিল করে সকল আইনকেই সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী করার প্রত্যয়ে আজকে এখানেই শেষ করছি, আল্লাহ্‌ হাফেজ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.