বিয়ের পূর্বেই যে টেস্টগুলো করিয়ে নিতে পারেন

বিয়ের পূর্বেই যে টেস্টগুলো করিয়ে নিতে পারেন

পারিবারিক আইন

সাবিহা এবং সুমনের বিয়ে হয়েছে ৬ মাসের মত হবে। উভয় পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিবাহ হয়েছে, যাকে আমরা বলে থাকি এরেঞ্জ ম্যারিজ। কিন্তু সুমনের কিছু সমস্যা ছিল যেগুলো বিয়ের ঘটক কিংবা সুমনের পরিবার কেউই সাবিহার পরিবারকে জানায়নি। বিয়ের পরপরই সাবিহা ধীরে ধীরে জানতে পারে যে, সুমন মাদকাসক্ত। শুধু মাদকাসক্তই নয়, তাকে ইতিপূর্বে রিহাব বা সংশোধনাগারে একাধিকবার পাঠানো হয়েছে। কিন্তু, সাবিহা যখন জানতে পারে তখন ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। সাবিহার গর্ভে সন্তান চলে আসেনি, তবে ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন যেমন হয়েছে তেমনি মানসিক ভাবেও সাবিহা সুমনকে ভালোবেসে ফেলেছে। যার ফলে প্রথমে শুনে সাবিহা অনেক কষ্ট পেয়েছে, সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা করেছে, প্রতারণার মামলা করার কথা ভেবেছে কিন্তু পরবর্তীতে সংসার করার মন-মানসিকতাতেই বিভিন্নভাবে সুমনকে মাদক থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালাতে থাকে।
সুমন নিজেও বিয়ে করার পর সাবিহার ভালোবাসা, মায়া-মমতায় ধীরে ধীরে মাদক থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্যা যখন গোঁড়ায়, তখন সেই সমস্যার সমাধান করতে গেলে গোড়ায় যেতে হবে।

 

একটি গাছের যখন শিকড়ে সমস্যা থাকে, তখন ঐ গাছকে উপর থেকে যতই ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টা চালানো হোক না কেন, সেটি কোনভাবেই ঠিক হবে না। গাছের উপরে যতই আপনি চিকিৎসা চালাবেন শিকড় থেকে সেটি ধীরে ধীরে ভেতরে ভেতরে নষ্ট হয়ে যাবেই। তেমনি একজন মাদকাসক্তর শিকড় হচ্ছে তার বন্ধুবান্ধব।
আপনি আজকে একটি জরিপ চালালে দেখতে পারবেন, বেশিরভাগ মাদকাসক্ত, এমনকি সাধারণ একটি সিগারেট পর্যন্ত প্রথম অভিজ্ঞতা হয় বন্ধু বান্ধবের মাধ্যমে। এখন তো বলা হয়ে থাকে, পর্ন আসক্তির মত বিষয়টিও প্রথম অভিজ্ঞতা হয় বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে। তাই বন্ধুবান্ধব যদি ভালো না হয় সেক্ষেত্রে আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল না হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি আপনার মাঝে বদ-অভ্যাসগুলো তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকাংশে থেকে যায়। তাই বন্ধু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সব সময় সাবধান থাকা উচিত।
একটি দুর্ঘটনা যেমন সারা জীবনের কান্না হতে পারে, তেমনি একজন ভালো মানুষের জন্য তার খারাপ বন্ধুবান্ধব সারা জীবনের অভিশাপ হতে পারে। একজন মাদকাসক্ত ছেলের জন্য শুধুমাত্র তার জীবনটাই বেদনার নয়, বরং তার পুরো পরিবারের জন্যই সেটি একটি কলঙ্কের অধ্যায় হয়ে থাকবে।
এখন আমাদের এই গল্পের নায়ক সুমন যখন মাদকাসক্ত হয়ে যায় এবং বিবাহের পূর্বে একাধিকবার তাকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয় এবং সংশোধন হয়ে আসার পরও সে পুনরায় ওই বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ফিরে যায়, তখন সে আবারও ওই মাদকের জগতে পা বাড়ায়। যার ফলে একের পর এক চিকিৎসার পরও যখন সুমন পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছিল না, তখন পরিবারের কোন একজনের পরামর্শে সুমনকে বিবাহ দেওয়ার কথা উঠে।

অনেকেরই ধারণা, বিবাহের পর সে হয়তো মাদক ছেড়ে দিবে, এই বিষয়টি এতটাই আপেক্ষিক যে কখনোই বলা যায় না যে কার বেলায় এটি কাজে লাগবে আর কার বেলায় কাজে লাগবে না। তবে, এটা সমাজের পুরনো একটি কৌশল, কাউকে সংশোধন করার জন্য। তাই, যদি কারো বেলায় কাজে লেগে যায়, সেক্ষেত্রে তো ভালো। কিন্তু যার বেলা কাজে লাগবে না, সেক্ষেত্রে আপনি আরেকটি মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছেন; এই বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত। আপনার সন্তানকে আপনারা সবাই মিলে ঠিক করতে পারছেন না, সেখানে আরেকটি মেয়ে একা আপনার সন্তানকে ঠিক করতে পারবে তার নিশ্চয়তা কি? উল্টো তার জীবনটা নরক হয়ে যেতে পারে, তার জীবন অনিশ্চয়তায়ও চলে যেতে পারে।
আমি ব্যক্তি এবং পেশাগত জীবনে অনেক মাদকাসক্ত এবং জুয়াড়ি দেখেছি যাদেরকে বিয়ে দিয়ে দিলে তারা ভালো হয়ে যাবে এই ধারনা থেকে, অথচ বিয়ে দেওয়ার পরে ঐ মেয়েটির জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই ডিভোর্সের পথ বেছে নিয়েছে, কেউ কেউ বা সন্তানদের দিকে তাকিয়ে অশান্তির দাম্পত্য জীবন মেনে নিয়েছে। তাই এক্ষেত্রে বিবাহের পূর্বে কয়েকটি টেস্ট করিয়ে নেওয়া আবশ্যক; একটি ভালো কেসের আশায় নয়টি মেয়ের জীবন নষ্ট করা কোন মতেই ভালো বিনিময় নয়।
টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই শুধুমাত্র বিবাহে সম্মতি দেওয়া উচিত। অনেকেই ভেতরে ভেতরে ইতিমধ্যে এই টেস্টের চাহিদাটি পাত্র পক্ষের কাছে জানাচ্ছে, কেননা দেশজুড়েই এখন মাদকের বিস্তার অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কিন্তু, ব্যক্তি পর্যায়ে এই টেস্টের চাহিদা অনেকেই অপমানজনক দৃষ্টিতে দেখছেন। তাই, এর সবচেয়ে কার্যকারিতা এবং সুফল পাওয়া যাবে যখন সরকার এটিকে বাধ্যতামূলক করবে।

সরকার ইতিমধ্যে মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে বিয়ের পূর্বে রক্তে বিভিন্ন রোগ যাচাইয়ের জন্য সচেতন করে থাকেন, কিন্তু এটিকে বাধ্যতামূলকের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। কেননা, শুধু মাদকাসক্তই নয়, এর বাহিরেও আরো অনেকগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলোর কারণে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে আর নিয়ম না থাকায় এগুলো গোপন করা হচ্ছে হরহামেশায়। যেমন, পুরুষত্বহীনতা; এই বিষয়টির কারণেও আজকাল ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে হুহু করে। বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই স্ত্রী টের পাচ্ছে তার স্বামী শারীরিকভাবে অক্ষম। বিভিন্ন চিকিৎসা করেও হয়তো তার অক্ষমতার সমস্যা দূর করা যাচ্ছে না, তখন বাধ্য হয়েই তালাকের পথ বেছে নিতে হচ্ছে। একজন নারীকে যেমন সন্তান জন্ম দিতে না পারার অজুহারে তালাক দেওয়া হচ্ছে, একই ভাবে অক্ষম পুরুষকেও তালাক দিতে এখন নারীরা উদ্যমী হচ্ছেন। দিন শেষে বিবাহের একটু বড় অংশ কিন্তু জৈবিক চাহিদা, সেটি বিসর্জন দেওয়া সবার পক্ষে সম্ভবপর নয়।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যদি একটি লোক বিয়ের আগেই বিয়ের জন্য অযোগ্য হয়, সেক্ষেত্রে তাকে বিয়েটা দিয়ে কেন শুধু শুধু একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করা হচ্ছে?
সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাসে আমরা দেখেছিলাম ‘দীপাবলি’কে দিয়ে কিভাবে বংশের প্রদীপ বাঁচিয়ে রাখার জন্য জোর করে একটি অসুস্থ ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে, হয়ত সরকার উদ্যমী নাহলে ভবিষ্যতেও ঘটবে। তাই, শীঘ্রই সরকারের উচিত এ ধরনের একটি আইন/নিয়ম করে দেওয়া যাতে, বিবাহের পূর্বে উভয়পক্ষ তাদের মধ্যে কোন শারীরিক অক্ষমতা রয়েছে কিনা বা তাদের শরীরে এইচআইভি’র মত কোন ভাইরাস রয়েছে কিনা বা মাদকাসক্ত কিনা সেগুলো নিশ্চিত করে তারপর বিবাহ করতে পারে।

শুধু ছেলেরাই নয়, আজকাল অনেক মেয়েদেরকেও মাদক গ্রহণ করতে শোনা যাচ্ছে। তাই উভয়পক্ষ টেস্ট করে তারপরই বিবাহের পিঁড়িতে বসা উচিত। সরকার যতদিন পর্যন্ত নিয়ম বা আইন করে দিচ্ছে না, ততদিন পর্যন্ত নিজ দায়িত্বেই নিজেদের মধ্যে এই বিষয়গুলো টেস্ট করা উচিত এবং এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা উচিত। এক্ষেত্রে অপরপক্ষের হয়তোবা আপত্তি করতে পারে, সেক্ষেত্রে আপনি নিজের টেস্টটা নিজে আগে করিয়ে তারপর আপনার হবু শ্বশুর বাড়িতে আপনার হবু স্বামী বা হবু স্ত্রীকে এই টেস্ট গুলো করানোর জন্য অনুরোধ করতে পারেন।
একটি চুক্তি করার জন্য যেমন আপনাকে চুক্তির সকল যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, ঠিক তেমনি বিবাহ যেহেতু একটি সামাজিক এবং ধর্মীয় চুক্তি, সেই চুক্তি করার জন্যও আপনাকে যোগ্য হতে হবে। আর বিয়ের অন্যান্য যোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি আপনাকে অবশ্যই শারীরিকভাবে ফিট থাকতে হবে; যাতে আপনি মাদকাসক্ত বা যৌনতায় অক্ষম কিংবা শরীরে কোন ধরনের ভাইরাস না থাকে।

 

আমাদের সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে গায়ের রং, উচ্চতার মত বিষয়গুলো নিয়ে কতই না নিষ্ঠুরতা করতে দেখা যায়, যেখানে এই বিষয়গুলোতে কারো কোন হাত নেই, কারণ আল্লাহই আমাদের এভাবে বানিয়েছেন। এগুলো নিয়ে কেউ কোন পাত্র বা পাত্রীকে প্রত্যাখ্যান করলে কোন কটূক্তি শুনতে হয় না, আমাদের আত্মসম্মানে বাঁধে না; কিন্তু যখনি একটি ছেলে কিংবা মেয়ে মাদকাসক্ত কিনা তার শরীরে কোন ভাইরাস রয়েছে কিনা কিংবা শারীরিকভাবে সক্ষম কিনা টেস্ট করার কথা বললেই শুরু হয়ে যায় নাক ছিটকানো। তাই, আসুন আমরা বিয়ের আগেই বিষয়গুলো টেস্ট করিয়ে নিয়ে প্রতারণা মুক্ত বিবাহ সম্পাদন করি। আর আপনার পরিচিত কারো বিয়ের কথাবার্তা চললে তাকেও বিষয়টি জানিয়ে সচেতন করুন। আপনার একটু সচেতনতাই পারে, একটি জীবন বা একটি সংসার বাঁচিয়ে দিতে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.