উত্তরাধিকার আইন সকল ধর্মের জন্য তাদের নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে পালন করা হয়। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য মুসলিম আইন অনুসারে আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য হিন্দু আইন অনুসারে। হিন্দু আইনের উত্তরাধিকার আবার দুই ভাগে বিভক্ত, মিতাক্ষরা আর দায়ভাগ। আমাদের বাংলাদেশে দায়ভাগ অনুসরণ করা হয়।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটি অনেকের কাছেই বেশ জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু কিছু ছোট টেকনিক জানা থাকলে, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন এবং এর মাধ্যমে সম্পত্তি হিসেব নিকেশ আপনার কাছে খুবই সহজলভ্য মনে হবে। তবে প্রথমেই বলে রাখা ভাল হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটি আসলে সরাসরি কোনো আইন থেকে নয় বরং ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম থেকে এডপ্ট করা হয়েছে। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সবচেয়ে সহজ বিষয়টি হচ্ছে৫৩ জনের একটি লিস্ট দেওয়া আছে এবং সেটি একটি ক্রম অনুসারে। এই ক্রমানুসারে আপনি যেটা সহজে মনে রাখতে পারেন সেটা হচ্ছে গিয়ে, সম্পত্তি পাওয়ার জন্য এই ৫৩ জনের লিস্টে অপেক্ষাকৃত শুরুতেই যারা থাকবে তারাই সম্পত্তি পাবে। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে যেমন আমরা দেখেছিলাম একসাথে অনেকেই সম্পত্তি পায়; অংশীদার হিসেবেও পায় আবার আসাবা লিস্ট থেকেও পায়। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে এই জটিলতা নেই। এখানে সরাসরি লিস্ট দেওয়া আছে, প্রথমেই যাকে পাওয়া যাবে তাকে সম্পত্তি দেওয়া হবে। তবে ছোটখাটো কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে যেমন ৫৩ জনের প্রথম চারজনকে শুধুমাত্র একসাথে সম্পত্তি দেয়া হয়। চারজন না থাকলে পরবর্তীতে যে থাকবে তাকেই সম্পত্তিতে দেওয়া হবে। এই ধরনের কিছু টেকনিক রয়েছে যেগুলো মাথায় নিলে আপনি হিন্দু উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টন নিজে নিজে করতে পারবেন।
প্রথমত, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে ৫৩ জনের যে তালিকা রয়েছে তার মধ্যে প্রথম চারজন একইসাথে সম্পত্তি পেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, যে ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন করা হবে তার যদি কোন পালক পুত্র থেকে থাকে সেই ক্ষেত্রে পালক পুত্র বায়োলজিক্যাল পুত্রের এক-তৃতীয়াংশ মালিক হবে।
তৃতীয়ত, একাধিক কন্যা সন্তান থাকলে কুমারী কন্যা সম্পত্তি পাবে কিন্তু বিবাহিত নিঃসন্তান কন্যা সম্পত্তি পাবে না।
চতুর্থত, মৃত ব্যক্তির স্ত্রী এবং পুত্র থাকলে স্ত্রী এক পুত্রের সমান সম্পত্তি পাবে।
পঞ্চমত, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে ৫৩ জনের যে তালিকা দেওয়া আছে, তাদের মধ্যে যেসব স্ত্রীলোক রয়েছে তারা সম্পত্তি বিক্রি বা কোন প্রকার হস্তান্তর করতে পারবে না। কেননা তারা শুধুমাত্র ভোগদখল করতে পারবে, কখনোই মালিকানা অর্জন করতে পারবে না। কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি যদি কোন স্ত্রী লোকের কাছে যায় অর্থাৎ তার স্ত্রী বা কন্যা এদের কাছে যায়, তাহলে এদের মৃত্যুর পরেও সম্পত্তি পুনরায় মৃত ব্যক্তির অন্য পুরুষ ওয়ারিশদের কাছে চলে যাবে। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত কোন পুরুষ উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাচ্ছে না ততক্ষণ পর্যন্ত এই সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন অনুসারে প্রথম মৃত ব্যক্তির পুরুষ উত্তরাধিকারদের জন্য অপেক্ষমাণ থাকবে।
তাছাড়া, সম্পত্তি বণ্টনের সময় যদি কোনো ওয়ারিশ মৃত হয় তাহলে মৃত ওয়ারিশের উত্তরাধিকাররা উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তি পাবে।
উপরিউক্ত ব্যতিক্রমগুলো মনে রাখলে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে সম্পত্তি বণ্টন খুবই সহজ।
দায়ভাগ অনুসারে মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিম্নে বর্ণিত ৫৩ জনের যে ক্রম দেওয়া হয়েছে, সেই ক্রম অনুসারেই বণ্টন করা হবে:
১। ছেলে
২। ছেলের ছেলে
৩। ছেলের ছেলের ছেলে
৪। স্ত্রী, ছেলের স্ত্রী, ছেলের ছেলের স্ত্রী, ছেলের ছেলের ছেলের স্ত্রী
৫। মেয়ে
৬। মেয়ের ছেলে
৭। বাবা
৮। মা
৯। ভাই, সহোদর ভাই না থাকলে বৈমাত্রেয় ভাই
১০। ভাইয়ের ছেলে, সহোদর ভাই না থাকলে বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছেলে
১১। ভাইয়ের ছেলের ছেলে, সহোদর ভাই না থাকলে বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছেলের ছেলে
১২। বোনের ছেলে
১৩। বাবার বাবা
১৪। বাবার মা
১৫। বাবার ভাই
১৬। বাবার ভাইয়ের ছেলে
১৭। বাবার ভাইয়ের ছেলের ছেলে
১৮। বাবার বোনের ছেলে
১৯। বাবার বাবার বাবা
২০। বাবার বাবার মা
২১। বাবার বাবার ভাই
২২। বাবার বাবার ভাইয়ের ছেলে
২৩। বাবার বাবার ভাইয়ের ছেলের ছেলে
২৪। বাবার পিসির ছেলে
২৫। ছেলের মেয়ের ছেলে
২৬। ছেলের ছেলের মেয়ের ছেলে
২৭। ভাইয়ের মেয়ের ছেলে
২৮। ভাইয়ের ছেলের মেয়ের ছেলে
২৯। চাচার মেয়ের ছেলে
৩০। চাচার ছেলের মেয়ের ছেলে
৩১। বাবার চাচার মেয়ের ছেলে
৩২। বাবার চাচার ছেলের মেয়ের ছেলে
৩৩। মায়ের বাবা (নানা)
৩৪। মায়ের ভাই (মামা)
৩৫। মায়ের ভাইয়ের ছেলে (মামায়ের ছেলে)
৩৬। মায়ের ভাইয়ের ছেলের ছেলে (মামায়ের ছেলের ছেলে)
৩৭। মায়ের বোনের ছেলে (মাসির ছেলে)
৩৮। মায়ের বাবার বাবা
৩৯। মায়ের বাবার ভাই
৪০। মায়ের বাবার ভাইয়ের ছেলে
৪১। মায়ের বাবার ভাইয়ের ছেলের ছেলে
৪২। মায়ের বাবার বোনের ছেলের ছেলে
৪৩। মায়ের বাবার বাবার বাবা
৪৪। মায়ের বাবার বাবার ভাই
৪৫। মায়ের বাবার বাবার ভাইয়ের ছেলে
৪৬। মায়ের বাবার বাবার ভাইয়ের ছেলের ছেলে
৪৭। মায়ের বাবার বাবার বোনের ছেলে
৪৮। মায়ের ভাইয়ের মেয়ের ছেলে
৪৯। মায়ের ভাইয়ের ছেলের মেয়ের ছেলে
৫০। মায়ের বাবার ভাইয়ের মেয়ের ছেলে
৫১। মায়ের বাবার ভাইয়ের ছেলের মেয়ের ছেলে
৫২। মায়ের বাবার বাবার ভাইয়ের মেয়ের ছেলে
৫৩। মায়ের বাবার বাবার ভাইয়ের ছেলের মেয়ের ছেলে।
প্রথম ৪ জন ব্যতীত আর সকলেই একটি ক্রমতেই পুরো সম্পত্তি পাবে। আর, যেকোনো ক্রমতেই একাধিক ব্যক্তির থাকলে তাদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব ক্ষেত্রেই সমহারে বণ্টন হবে।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে কিছু লোককে উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়ে থাকে। চলুন জানি, এরা কারা?
প্রথমত, ধর্মচ্যুত হলেও অর্থাৎ কেউ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করলে, তাকে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হবে।
দ্বিতীয়ত, অসতী স্ত্রী অর্থাৎ যদি কোন বিবাহিত স্ত্রীলোক অসতী হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীলোকটি উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তি পাবে না।
তৃতীয়ত, যার কাছ থেকে সম্পত্তি পাবে তাকেই যদি হত্যা করা সেক্ষেত্রে আপনি তার কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে কোন সম্পত্তি পাবে না।
চতুর্থত, প্রতিবন্ধীদেরকে সাধারণত সম্পত্তি দেওয়া হয় না। যেমন, অন্ধ, বধির, মূক, পুরুষত্বহীন, অঙ্গহীন, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, দুরারোগ্য ব্যক্তিদেরকে উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি দেয়া হয় না, কেননা তাদেরকে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য করা হয় না। যার ফলে তারা উত্তরাধিকার হিসেবে কোন সম্পত্তি পায় না।
পঞ্চমত, সন্ন্যাসীরা যেহেতু সংসার ছাড়া হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে সন্ন্যাসীদেরকেও হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে সম্পত্তি দেওয়া হয় না।
এই হল, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের মোটামুটি বেসিক একটি ধারনা যার মাধ্যমে আপনি নিজে নিজেই সহজে হিন্দু উত্তরাধিকার হিসেব নিকেশ করতে পারবেন। তারপরও কোন জটিলতা থেকে থাকলে মেইল করতে পারেন, আমরা লিগ্যাল ফিস্ট টিম সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো স্লভ করার জন্য। ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )