নারী ঘটিত বিষয় নিয়ে রফিক এবং শফিকের মধ্যে আকস্মিক মারামারি লেগে যায়।মারামারির এক পর্যায়ে শফিক খেয়াল করল যে, রফিকের হাতে ধারালো অস্ত্র এবং রফিক শফিককে খুন করেই ছাড়বে। শফিক তাৎক্ষণিক ঠিক করলো, যদি নিজে বাঁচতে হয় তাহলে রফিককে মারতে হবে। অন্যথায় রফিক অবশ্য শফিককে খুন করবে।
যেই ভাবা সেই কাজ, শফিক রফিকের হাত থেকে অস্ত্র দাঁড়াল কেড়ে নেওয়ার শক্তি যখন নেই তখন পাশে থাকা ষ্টীলের স্কেল দিয়ে রফিককে এলোপাথাড়ি যেভাবে আঘাত করল তাতে রফিক চরম রক্তাক্ত হয় এবং মারাত্মক জখম হয়। অবস্থা বেগতিক এবং রফিকের শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে দেখে শফিক ঘাবড়ে গিয়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে রফিককে কেউই যথা সময়ে হাসপাতালে নিতে পারেনি বলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে যায় এবং যখন হাসপাতালে নেওয়া হয় তখন তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পুলিশ শফিককে গ্রেফতার করে এবং কারাগারে প্রেরণ করে।
লম্বা সময়ের জন্য শফিকের জেল জরিমানা হবে; এতে কোনও সন্দেহ রইল না। একাধিক জামিনের আবেদন করেও যখন জামিন মঞ্জুর হল না তখন শফিক কারাগারে বসে বসে চিন্তা করতে লাগছিল, এই কারাগারের জীবন ভাল নাকি তার বাইরের জীবনটা ভাল ছিল?
অপরাধীদেরকে কারাগারে বন্দি করে রাখার যে সার্বজনীন উপকরণ সেটি আসলে কতটা উপযুক্ত কে জানি। কারাগারে একটি মানুষকে খেতে দেওয়া হয়, ঘুমোতে দেওয়া হয়, আহামরি কোনও কাজ থাকে না, বাহির থেকে আরাম আয়েশের জীবনের মত মনে হয়। কিন্তু তারপরও মানুষ কারাগারে থাকতে চায় না কেন?
কারণ মানুষ স্বভাবসুলভ ভাবেই স্বাধীন থাকতে পছন্দ করে। নিজের মতো করে চলাফেরা, নিজের মতো করে ঘুমানো, নিজের মতো করে খাওয়া, নিজের মতো করে বন্ধু বান্ধবদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর যে স্বাধীনতা, সেটি যখন খর্ব করা হয় তখন একটি মানুষ যতটা যিনি নিজেকে জীবিত মনে করে তার চেয়ে বেশি নিজেকে মৃতই মনে করে।
শফিক একদিন বসে বসে চিন্তা করছিল, ‘কেন আমি রফিককে খুন করলাম। কারাগার নামক এই নরকে থাকার চাইতে আমি তো রফিকের হাতে খুন হওয়াটাই ভালো ছিল। বেঁচে থাকাটাই যদি জীবনের মূল লক্ষ্য হয়। সেই লক্ষ্যে হয়তো আমি কৃতকার্য হয়েছে। কিন্তু জেলখানা নামক নরকে বেঁচে থাকার চাইতে রফিকের হাতে খুন হওয়াটাই ভালো ছিল। অন্তত এই নরকে আমাকে ঝুলতে হতো না’।
যাদের কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে তারাই শুধুমাত্র শফিকের এই ভারাক্রান্ত মনের কষ্টটা বুঝতে পারবেন। গল্প পড়ে কিংবা সিনেমা দেখে কখনোই জেল জীবনের কষ্ট বোঝা সম্ভব নয়।
উপরের গল্প এবং চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও বিষয়টি আমি লিখছি কিছুদিন আগে ভারতীয় এক কয়েদির বক্তব্য থেকে। ভারতের এক কয়েদি মুক্তির পর বলছিল যে, তার বন্ধুর সাথে তার এমন অবস্থা তৈরি হয়েছিল যে, সে যদি তার বন্ধুকে খুন না করত তাহলে তার বন্ধু তাকে খুন করত। এমতাবস্থায় সে তার বন্ধুকে খুন করে। কিন্তু সে কোনভাবেই সেটি প্রমাণ করতে পারছিল না যে সে আত্ম রক্ষার্থে খুন করেছে। আর যার ফলশ্রুতিতে এখন থাকে জেলে পচে মরতে হচ্ছে। তাই তার বারবারই অনুশোচনা হচ্ছে, কেন সে তার বন্ধুর হাতে খুন হল না। তাহলে অন্তত এই জেলখানায় পচে মরতে হতো না। তার বন্ধুই বরং মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।
এবার চিন্তা করুন ওই জেলখানায় যেখানে নরকের অভিজ্ঞতা হয় সেখানে বসে যদি কেউ শুনতে পায় যে, তার নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেছে তখন তার মনের অবস্থা কেমন হয়?
মানুষ মরে গেলে তার সাথে কথা বলা যায় না। পরস্পর জড়িয়ে ধরা যায় না। তারপরও মানুষ দূর দূর দেশ থেকে চলে আসে তার বাবাকে, মাকে, কাছের মানুষটাকে এক নজর দেখার জন্য, নিজ হাতে কবর দেওয়ার জন্য। সেই জায়গায় যখন নিজের দেশে, হয়তো নিজের শহরে বা নিজের জেলার মধ্যে কারাগারে থাকা অবস্থায় তার নিকটাত্মীয় কেউ মারা যায় তাকে শেষ বারের জন্য দেখা, তাকে কবর দেয়ার ইচ্ছার পথে বাঁধা তার কারাবাস।
যারা কারাবন্দী রয়েছেন তারা চাইলে তাদের এই ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থাৎ নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করে মৃত ব্যক্তিকে দেখতে এবং তাকে কবরস্থ করার সুবিধা পেতে পারেন। ২০১৬ সালের পহেলা জুন একটি নীতিমালা প্রকাশ করা হয় যেখানে প্যারোলে মুক্তি সংক্রান্ত কিছু নীতিমালা উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী যারা এবং যেসব কারণে একজন ব্যক্তি প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন তা নিম্নরূপ:
কোন ভিআইপি বা অন্য সকল শ্রেণির কয়েদী বা হাজতি বন্দিদের নিকটাত্মীয় যেমন বাবা মা, শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, সন্ততি এবং আপন ভাই বোন মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যায়।
নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোন আদালতের আদেশ কিংবা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দিকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে।
প্যারোলে মুক্তির সময়সীমা কোন অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার অধিক হবে না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস বৃদ্ধি করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।
প্যারোলে মুক্তি থাকা অবস্থায় বন্দিকে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরাধীনে রাখবে।
বন্দি যেখানে আটক অবস্থায় আছে এবং বন্দী যেখানে যেতে চায় তার দূরত্ব বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর কিংবা নামঞ্জুরের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে। এখন একজন ব্যক্তি যদি এক জেলায় অবস্থান করে এবং তার আত্মীয়স্বজন সুদূর অন্য কোনো জেলায় অবস্থান করে সেক্ষেত্রে তার যাওয়া আসা অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ হলে কর্তৃপক্ষ প্যারোল না মঞ্জুর করতে পারেন। তবে যৌক্তিক দূরত্বের মধ্যে যদি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ মঞ্জুর করতে পারবেন।
এখন আপনার প্রশ্ন আসতে পারে, প্যারোল মঞ্জুর কর্তৃপক্ষ কে বা কারা?
সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে বিবেচিত হবেন।
দূরত্ব যেমনই হোক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টিকে সরকার অধিকার হিসেবে প্রদান করলে সবচেয়ে ভালো। জামিনযোগ্য অপরাধে যেমন জামিন পাওয়া আইনগত অধিকার, একইভাবে নিকটাত্মীয় মৃত্যুতে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টিকেও আইনগত অধিকার হিসেবে বাস্তবায়ন করা উচিত। যদি এই ক্ষেত্রে দূরত্ব অনেক বেশি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও এই বিষয়টিকে মানবতার দৃষ্টি থেকে দেখা উচিত; এতে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি বৃদ্ধি পাবে।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )