Witness are the eyes and ears of justice– সাক্ষীরাই হচ্ছেন বিচার তথা বিচারকের চোখ এবং কান। কেননা, আমরা জানি, আইনের চোখ অন্ধ, যার ফলে আইন সাক্ষীর চোখ এবং কান দিয়েই দেখে থাকে। যার ফলে, একজন সাক্ষী কি দেখেছেন এবং কি শুনেছেন, সে বিষয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী, সাক্ষী নিজে যেটা দেখেছেন এবং নিজে সেটা শুনেছেন, সেগুলোকেই মুখ্য সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু, অন্যের নিকট থেকে শুনে এসে কোন সাক্ষ্য দিলে সেই সাক্ষ্যকে গৌণ হিসেবে গণ্য করা করা। তাহলে বুঝতেই পারছেন, সাক্ষী কতটা গুরুত্বপূর্ণ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য।
সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী, সাক্ষ্য ২ প্রকার। প্রথমত, মৌখিক সাক্ষ্য, যা আমরা মুখে বলে আদালতের কাছে উপস্থাপন করে থাকি। যারা কথা বলতে পারে না, তারা ইশারায় বা লিখে যে সাক্ষ্য প্রদান করে, তাকেও মৌখিক সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, দালিলিক সাক্ষ্য। ডকুমেন্টস বা কাগজপত্রের মাধ্যমে যখন কোন মামলার সাক্ষ্য দেওয়া হয়, তখন তাকে দালিলিক সাক্ষ্য বলা হয়ে থাকে। বিশেষ করে, জমি জমা সংক্রান্ত বিষয় এবং ব্যক্তিগত লেনদেন বা ব্যাংক কোম্পানি সংক্রান্ত বিষয় গুলোতে কোন দ্বন্দ্ব বা বিরোধ উত্থাপিত হলে, তখন সে বিষয়ে আদালতে নিজের দাবীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে গেলে মৌখিক সাক্ষ্যের চেয়ে দালিলিক সাক্ষ্যই বেশি উপযোগী। তাই, মামলার বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে, কখনো আদালতে মৌখিক সাক্ষ্য দিতে হয়, কখনো বা দালিলিক সাক্ষ্য দিতে হয়। এতটুকু আশা করি আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি। আজকে আমরা আলোচনা করবো, মিথ্যা সাক্ষ্য এবং এর সাথে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলা হয় কোথায় জানেন?
ধর্মীয় গ্রন্থ ছুঁয়ে অর্থাৎ শপথ গ্রহণ করে, যেটা হয় আদালতে।
আর সবচেয়ে বেশি সত্য কথা কোথায় বলা হয়ে জানেন?
অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সেটি নাকি মদ ছুঁয়ে, পানশালাতে।
কথা গুলো আমার নয়, বলেছেন উর্দু ভাষার কবি মির্জা গালিব।
আদালতে নিজের দাবীকে শক্ত পোক্ত করার জন্য অনেকেই মিথ্যা সাক্ষ্যের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। যখন দাবীটিই মিথ্যা, তখন তো মিথ্যা সাক্ষ্য ব্যতীত কোন উপায় নেই। আর যখন দাবী সত্য কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব, তখনো অনেকেই নিরুপায় হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের দাবী প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এখানে দাবী বলতে, আদালতের নিকট যে দাবী জানানো হচ্ছে, সেটাকে বুঝানো হয়েছে। যেমন, খুন বা জখমের বিরুদ্ধে ন্যায় বিচারের দাবী, জমিজমা বা দেওয়ানী অধিকার আদায়ের দাবী ইত্যাদি।
দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ১৯১ ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি যদি আইনত বাধ্য হয় শপথের মাধ্যমে বা আইনের স্পষ্ট বিধান দ্বারা, সত্য প্রকাশ করার জন্য বা আইনত বাধ্য হয় কোন বিষয়ে একটি ঘোষণা দেওয়ার জন্য, তখন সে এমন কোন বিবৃতি দেয় যা মিথ্যা এবং যা সে হয় জানে বা বিশ্বাস করে যে তা মিথ্যা বা সে সত্য বলে বিশ্বাস করে না, সেক্ষেত্রে একে মিথ্যা সাক্ষ্য বলা হয়ে থাকে।
এই ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা সাক্ষ্য মৌখিক ভাবে বা অন্য যেকোনো ভাবেই প্রদান করা হোক না কেন, তা মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবেই গণ্য হবে।
কেউ যদি কোন মিথ্যা সাক্ষ্যকে প্রত্যয়ন করে, তবে সেটিও এই ধারার অধীন মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবে প্রতীয়মান হবে।
একজন ব্যক্তি একটি বিষয় বিশ্বাস না করেও যদি কাউকে বলেন যে তিনি তা বিশ্বাস করেন, তবে তা মিথ্যা সাক্ষ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। একই ভাবে, একজন ব্যক্তি একটি বিষয় না জেনেও যদি কাউকে বলেন যে তিনি তা জানেন, তবে তাও মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে।
যেমন, জনাব, মাসুদ সত্য বলার শপথে আবদ্ধ হয়ে বলে বলেন যে, একটি নির্দিষ্ট স্বাক্ষরকে জনাব রহিমের হস্তাক্ষর বলে বিশ্বাস করেন, অথচ জনাব মাসুদ বিশ্বাস করেন না যে এটি জনাব রহিমের হস্তাক্ষর। এখানে যেহেতু জনাব মাসুদ যেহেতু বিশ্বাস করতে না, তবুও বিশ্বাস করেন বলেছেন, তাই ইহা মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে।
আবার, জনাব মাসুম একজন দোভাষী বা অনুবাদক, একটি নথির বিবৃতির সত্য ব্যাখ্যা বা অনুবাদ বা প্রত্যয়ন করেন, যা তিনি সত্য ব্যাখ্যা বা অনুবাদ করতে শপথ দ্বারা আবদ্ধ, অথচ তিনি তা সত্য ব্যাখ্যা বা অনুবাদ বলে বিশ্বাস করেন না। এমতাবস্থায়, এমন অনুবাদ বা ব্যাখ্যাও মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কখন একটি সাক্ষ্যকে মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করবো বা কি দেখে বা কোন প্যারামিটারে মেপে আমরা একটি সাক্ষ্যকে মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবে অভিহিত করবো?
মিথ্যা সাক্ষ্যের কিছু ক্ষেত্র এবং উপাদান রয়েছে, যেগুলোর বিচারে আমরা একটি সাক্ষ্যকে মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবো। নিম্নে এর বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
মিথ্যা সাক্ষ্যের ক্ষেত্র: শপথ বা আইনের বিধান অনুসারে যখন সত্য বলা বা সত্য ঘোষণা দিতে বাধ্য, তখন কেউ মিথ্যা বললে বা মিথ্যা ঘোষণা দিলে আমরা তাকে মিথ্যা সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করবো। কেননা, আমরা সারাদিনই অনেক কথা বলি এবং কথার মধ্যে সত্য, মিথ্যা, অর্ধেক সত্য, অর্ধেক মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা অনেক ধরনের কথাই থাকে। সর্বদাই সত্য কথা বলা উচিত এবং উত্তম। কিন্তু, প্রয়োজনে অনেকেই বা অকাজেই মিথ্যা কথা বলে, যা হয়ত সরাসরি অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠে না। যখনি একটি মিথ্যা অন্যায় ভাবে অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠে বা কোন একটি বিরোধের সৃষ্টি করে, তখনি মিথ্যার কালো রূপটি বিশেষ ভাবে প্রতীয়মান হয়। তাই, শপথ নিয়ে বা আইনের বিধান অনুসারে যখন সত্য বলা উচিত, তখন যদি কেউ মিথ্যা বলে তখন তাকে মিথ্যা সাক্ষ্য বলা হবে।
মিথ্যা সাক্ষ্যের উপাদান: মিথ্যা সাক্ষ্যের উপাদান বলতে মিথ্যা বলার ভঙ্গিমা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কোন প্রশ্নের উত্তরে চুপ করে থাকা যেমন মৌন সম্মতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তেমনি মিথ্যা সাক্ষ্য শুধু শপথ নিয়ে বা আইনের বিধান অনুসারে যখন সত্য বলা উচিত তখন মিথ্যা বলাকেই বুঝায় না। বরং, মিথ্যা সাক্ষ্য বলতে বুঝায় শপথ নিয়ে বা আইনের বিধান অনুসারে যখন সত্য বলা উচিত, তখন-
- মিথ্যা বলা (আঞ্চলিক ভাষায় ডাহা মিথ্যা),
- যেটা সে মিথ্যা বলে জানে,
- যেটা সে সত্য নয় বলে জানে
- যেটা সে মিথ্যা বলে বিশ্বাস করে,
- যেটা সে সত্য বলে বিশ্বাস করে না।
শাস্তি: বিচারিক কার্যক্রমে মিথ্যা সাক্ষ্য দানের শাস্তি হচ্ছে যেকোনো বর্ণনার ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। আর বিচারিক কার্যক্রম ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য দানের শাস্তি হচ্ছে যেকোনো বর্ণনার ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )