আমরা প্রায়ই খবরে দেখতে পাই যে, স্বামী হত্যার দায়ে স্ত্রীকে বা স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামী গ্রেফতার করা এবং কতিপয় ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তদন্ত রিপোর্টে দেখতে পাওয়া যায় যে, উক্ত হত্যার সাথে স্ত্রী বা স্বামীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা একটি যুগান্তকারী মামলা দেখতে পেয়েছিলাম যেখানে স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে পরবর্তীতে দেখা গেলো স্ত্রী নিজেই উক্ত খুনের সাথে জড়িত এবং আদালত তাকে শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত করেছে। রায় কি হয়েছে, সেটি আপনাদের জানা আর যারা জানেন না গুগল করে নিতে পারেন।
যাই হোক, এমন অনেক ঘটনা আমরা এখন খবর দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি বলে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না। অথচ, স্বামী স্ত্রীর মাধ্যমে যে পরিবারের জন্ম হয়, সেটি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানের সদস্য আমি আপনি সকলেই। কিন্তু, যত দিন যাচ্ছে ততই যেন এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানটি কোন না কোন ভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বা নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি ভেঙ্গে দিয়ে আমাদেরকে ক্রমেই একা একা জীবন অতিবাহিত করার দিকে জোর করে ঠেলে দিচ্ছে। এখন ছেলে মেয়েরা বিয়ে করতে চাচ্ছে না, আগে যেখানে ২৫ এ বিয়ে করার ট্রেন্ড ছিল, সেখানে এখন ৩২ এ ও ব্যাচেলর তকমা লাগিয়ে ঘুরতে যুবকরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তারপরও যারা বিয়ে করছে তাদের মধ্যে আবার বাচ্চা নিতে অনীহা রয়েছে অনেকেরই, সরকার যেখানে ‘দুই সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’ নীতিতে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে ২ টি বাচ্চা নিতেও অনেকেরই অনীহা। অনেকেই হয়ত অর্থনৈতিক দিকটাকে দায়ী করবেন, কিন্তু এর পিছনে কেবলই অর্থনীতি দায়ী, এটি কিন্তু ঠিক নয়। এদিকে বিয়ের সংখ্যা যে হারে কমছে, একই হারে তাল মিলিয়ে বাড়ছে তালাক বা ডিভোর্সের সংখ্যা। এইসব কিছুর মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের, সেটি হচ্ছে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন কিংবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন। এটি কতটা আতঙ্কের, সেটি আসলে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আজকে আমরা আলোচনা করবো, স্বামী হত্যার দায়ে স্ত্রী বা স্ত্রী হত্যার দায়ে কেন স্বামীকেই প্রথম সন্দেহ করা হয়?
আমরা সাধারণত জানি যে, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১০১ ধারা অনুযায়ী, প্রমাণের দায়ভার বলতে সাধারণত বুঝতে হবে, মামলা প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব। ইংরেজিতে একে বলে, burden of proof. সহজ ভাষায় বললে, সাধারণত যে পক্ষ মামলা দায়ের করে সে পক্ষ (রাষ্ট্র পক্ষ বা অভিযোগকারী) যে অভিযোগ আনয়ন করে, তাকেই তা প্রমাণ করতে হবে। যেহেতু ফৌজদারি মামলায় সাধারণত রাষ্ট্র পক্ষ বাদী থাকে, যা আমরা GR/জিআর মামলা হিসেবে জানি, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র পক্ষকেই অভিযোগটি প্রমাণ করতে হবে। আবার অনেকেই সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করে থাকেন যেগুলোকে আমরা CR/সিআর মামলা হিসেবে জানি, সেক্ষেত্রেও অভিযোগকারী অর্থাৎ বাদীকেই তার আনিত অভিযোগ গুলো নিজ দায়িত্বে প্রমাণ করতে হবে। সাক্ষ্য আইনে প্রমাণের দায়ভারের প্রাথমিক নিয়মই হচ্ছে, যে যেটা দাবী করবে, তাকে সেটাই প্রমাণ করতে হবে। একজন ব্যক্তি যখন দাবী করবে তার কাউকে হত্যা করা হয়েছে, তখন থানায় অভিযোগ দায়ের করলে সাধারণত রাষ্ট্র পক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে সেই অভিযোগ অনুযায়ী প্রমাণ করা। কিন্তু, স্বামী বা স্ত্রী খুন হলে স্ত্রী বা স্বামী যখন থানা বা আদালতে অভিযোগ দায়ের করে, তখন উক্ত স্ত্রী বা স্বামীকেই প্রথমে ব্যাখ্যা করতে হয় যে, কিভাবে তার স্বামী বা স্ত্রী খুন হয়েছে বা মারা গেছে। কেননা, স্বামী স্ত্রী যেহেতু দুই শরীর হলেও এক সত্ত্বা, তাই কোন ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে সেটি তার স্ত্রী বা স্বামীর বিশেষ অবগতির মধ্যে থাকে, সেহেতু এই বিশেষ অবগতির জন্য স্ত্রী বা স্বামীকেই প্রথমে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, কিভাবে তার স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলো।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১০৬ ধারা অনুযায়ী, কোন বিষয় যখন বিশেষ ভাবে কোন ব্যক্তির অবগতির মধ্যে থাকে, তখন সেই বিষয় প্রমাণ করার দায়িত্ব তার উপরই ন্যস্ত থাকে। অর্থাৎ, কোন একটি ঘটনা বা বিষয় যখন নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির জানার কথা বা নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি ব্যতীত অন্যরা জানার কথা নয়, তখন ঐ ব্যক্তির উপরই প্রমাণ করার দায়িত্ব বর্তাবে। যাকে ইংরেজিতে বলে, Burden of proving fact especially within knowledge.
এটি সাধারণ নিয়মের একটি ব্যতিক্রম তবে এটি কিন্তু অন্য দৃষ্টিতে স্বাভাবিক। কেননা, কোন বাসায় বা বাড়িতে যদি কোন ব্যক্তি খুন হয়, তখন কিন্তু ঐ বাসা বা বাড়ির লোককেই প্রথমে ব্যাখ্যা করতে হয় যে, কিভাবে ঐ ব্যক্তি মারা গেলো বা খুন হল। কেননা, যে বাসায় মারা গেছে, সেই বাসার লোকদেরই এটি বিশেষ অবগতির বিষয়।
আরেকটি উদাহরণ দিলে একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে, যখন কোন আসামীকে কারাগারে বন্দী রাখা হয় তখন ঐ আসামী কারাবন্দী অবস্থায় যদি মৃত্যুবরণ করে, তখন ঐ কারাবন্দীর মৃত্যু কিভাবে হল এটি নিয়ে সর্বপ্রথম কিন্তু ঐ সেলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকেই ব্যাখ্যা দিতে হবে। কেননা, কারাবন্দীর মৃত্যু যেহেতু কারাবন্দী অবস্থায় ছিল এবং ঐ কারার দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনিই বিশেষ ভাবে অবগত আসলে কি হয়েছে।
ঠিক একই কারণে, কোথাও কোন স্বামী খুন হলে স্ত্রীকেই প্রথমে ব্যাখ্যা দিতে হয় কিভাবে তিনি খুন হলেন আবার একই ভাবে স্ত্রী খুন হলে স্বামীকেই প্রথমে ব্যাখ্যা দিতে হবে কিভাবে স্ত্রী খুন হলেন। যার ফলশ্রুতিতে, স্বামী হত্যার দায়ে স্ত্রী বা স্ত্রী হত্যার দায়ে কেন স্বামীকেই প্রথম সন্দেহ করা হয়।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )