জমি কেনার সময় কি করবেন

জমি ক্রয়ের আগে ক্রেতার করণীয়ঃ পর্ব ৬

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

জমির মালিকানা হস্তান্তর হয় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে আর ভূমি অফিসে খতিয়ান থেকে পুরনো মালিকের নাম করে খারিজ করে নতুন মালিকের নাম নামজারির মাধ্যমে। এখন দলিলের ভিত্তিতে জমির মালিক হওয়াটাই কিন্তু যথেষ্ট না। আপনাকে ভূমি অফিসে ঐ জমি যেই খতিয়ানের যেই দাগে সেই খতিয়ান থেকে সেই দাগ থেকে আপনি যতটুকু জায়গা ক্রয় করেছেন, ততটুকু কেটে নিয়ে নিজের নামে আলাদা নামজারি করাতে হবে। এখন এই নামজারির কাজ তো জমি ক্রয়ের পরের কাজ, কিন্তু এখানে তো আলাপ করা হচ্ছে, জমি ক্রয়ের পূর্বের সতর্কতা নিয়ে।
জি, প্রায় সব ক্ষেত্রেই জমি ক্রয়ের পর জমির খারিজ বা নামজারির জন্য আবেদন করে থাকে। কিন্তু, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন যে, জমি ক্রয় করেছে আজ ১০ বছর অথচ আজও খারিজ করাতে পারছে না। কেননা, জমির মালিক যদি চিটিংবাজি করে থাকে গোপনে তাহলে আপনি সেটা বাহির থেকে ধরতে পারবেন না।
এখানেও একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে বুঝানো যাক, তাহলে এর গুরুত্ব ঠিকভাবে রপ্ত করতে পারবেন। আমার এক আত্মীয় আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে একটা জমি ক্রয় করেছিল প্রায় ৪ শতাংশ পরিমাণ। কিন্তু, আজকে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে অথচ এখনো নামজারি করাতে পারেনি। এর কারণ হচ্ছে, বিক্রেতা বিক্রি করার আগেই বা পরপরই ঐ জমি নিজ ছেলের নামে নামজারি করিয়ে নিয়েছেন যেকোনো দলিল মূলে। এখন যে খতিয়ানের যে দাগ থেকে সম্পত্তি বিক্রি করা হয়েছিল, সেই খতিয়ানের সেই দাগে বিক্রেতার নামে আর অবশিষ্ট কোন জমি নেই যা ক্রেতা নিজ নামে খারিজ বা নামজারি করাবে। বিক্রেতা ভুলবশত বা কোন অসদুদ্দেশ্যে নিজ ছেলের নামে জমি খারিজ বা নামজারি করাতে নিজ নামে উক্ত দাগে যে পরিমাণ জমি ছিল তা কাটিয়ে নিয়ে গেছে। এখন আর অবশিষ্ট কোন জমি নেই যেটা ক্রেতার নামে খারিজ বা নামজারি করিয়ে দেওয়া যায়। খতিয়ান থেকে জমি কেটে নিয়ে চলে যাওয়া, জমি না থাকা এগুলো অনেক জটিল বিষয় যা লিখে অনেকটা বুঝানো মুশকিল, তারপরও যতটা সম্ভব তা বুঝানোর চেষ্টা করেছি।
ধরুন, বিএস জরিপ আপনার নামে একটা খতিয়ান হল যার নাম্বার ৭৭২, এই খতিয়ানে কয়েকটি দাগ আছে যেমন ১০২৪, ১০২৫, ১০২৮, ১০৩০। আপনার এক খতিয়ানে ৪ দাগে সম্পত্তি রয়েছে। এই ৪ টি দাগে বিভিন্ন পরিমাণে জমি রয়েছে। আবার ধরুন, ১০২৪ দাগে ৫ শতাংশ, ১০২৫ দাগে ২ শতাংশ, ১০২৮ দাগে ১২ শতাংশ, ১০৩০ দাগে ৪ শতাংশ। এখন আপনি আপনার ৭৭২ নং খতিয়ানের ১০৩০ নং দাগের ৪ শতাংশ জায়গা আমার কাছে বিক্রি করবেন। আমি কাগজপত্র দেখে আপনার জমি ক্রয় করে ফেললাম। কিন্তু, পরবর্তী আমি যখন দলিল নিয়ে ভূমি অফিসে গেলাম এবং আমার নাম কর্তন করে ১০৩০ দাগে আমার নাম বসাতে বললাম, তখন তারা বলল ১০৩০ দাগে তো আপনার বিক্রেতার নাম নেই, তবে হ্যাঁ আগে ছিল এখন নেই। আমি যখন জানতে চাইলাম, এখন কার নাম রয়েছে, তারা জানালো এটা আপনার ছেলে বা স্ত্রীর নাম। অর্থাৎ, আপনি আমার কাছে বিক্রির আগে বা পরে আপনার স্ত্রী বা ছেলের নামে আরেকটা দলিল করে তাদের নামে জমিটা খারিজ করে দিয়েছেন, এখন তাই আমি যেহেতু আপনার কাছ থেকে জমি ক্রয় করেছি, সেহেতু আপনার নাম কর্তন করে আমার নাম বসানোর সুযোগ আছে তহসিলদারের। কিন্তু আপনার ছেলের নাম কেটে আমার নাম বসানোর সুযোগ নেই। এইসব ক্ষেত্রে মামলার মাধ্যমে সংশোধন করা যায়, কিন্তু জমির যা দাম হয়ত তার অর্ধেকেরও বেশি খরচ হয়ে যাবে এই মামলা পরিচালনা করতে আর কতো বছর লাগে সেটা নিয়ে আজ না হয় নাই বললাম। তাই, একটু বুদ্ধি খাটিয়ে জমি ক্রয়ের পূর্বেই যদি জমিটি বিক্রেতার নামে খারিজ বা নামজারি করা আছে কিনা সেটা একটু যাচাই বাছাই করে নিলে কি সমস্যা হতো?
আবার আরেকটা ঘটনা বলি, জমি কেনার সময় দলিল থেকে দলিল হওয়ার কারণে অনেকেই জমি মাপার প্রয়োজন বোধ করে না। তখন দেখা যায়, চৌহদ্দি নিয়ে ঝামেলা না থাকলেও পরিমাণে আংশিক কম থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি থেকে থাকে। চোখের আন্দাজে কখনো জমি ক্রয় করা উচিত না, ৪৩৫.৬ স্কয়ার ফুট বা বর্গফুটে এক শতক, আপনি এবার হিসেব করে দেখুন প্রতি স্কয়ার ফুট জায়গার দাম কতো করে পড়ছে?
একজন সার্ভেয়ার বা আমীনকে দিয়ে একটা জমি মাপাতে সর্বোচ্চ ৫/৬ হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ, আপনি যদি মিনিমাল ১ শতক জায়গা ১ লক্ষ টাকা হারে ক্রয় করেন, আর যদি পুরো জমিতে মাত্র ১৫/২০ স্কয়ার ফুট জায়গা কম পেয়ে থাকেন, তাহলেই কিন্তু প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকার জমি আপনার কম পেলেন। এই হিসেবটা কিন্তু কখনোই আপনাকে কেউ স্পষ্ট ধরিয়ে দিবে না। আপনি নিজে ক্যালকুলেটর হাতে নিন, ১ শতক জায়গার মূল্য যত পড়ছে, তাকে ৪৩৫.৬ দিয়ে ভাগ দিন, তাহলে প্রতি স্কয়ার ফুটের দাম বের হয়ে যাবে। জায়গা কিনে সবাই কানায় কানায় স্কয়ার ফুট বুঝে পায় না, বেশির ভাগই কয়েক স্কয়ার ফুট কম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অথচ, শুরুতেই সার্ভেয়ার বা আমীনকে দিয়ে মাপিয়ে জায়গা ক্রয় করলে জমি কানায় কানায় স্কয়ার ফুট না পেলেও যে কয় স্কয়ার ফুট কম পেলো সেই অনুসারে কম টাকা তো দিতে পারতো। একবার হিসেবটা করে দেখুন, যেখানে শতক ১০ লক্ষ টাকা করে, সেখানে ১ স্কয়ার ফুটের দাম পড়ছে, ২২৯৫ টাকা। প্রশ্ন করতে পারেন, ১ স্কয়ার ফুট কতটুকু?- ১ টা টাইলস যতটুকু জায়গা দখল করে সেই পরিমাণ জায়গার মূল্য দাঁড়াচ্ছে ২২৯৫ টাকা। এবার নিজের কেনা জমিটা নিজে নিজে মাপ দিয়ে দেখুন তো,বিক্রেতাকে কয় টাকা বেশি দিয়েছিলেন জমি কেনার সময়?

[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ ।| পর্ব  ২ | পর্ব ৩ ।| পর্ব  ৪ | পর্ব ৫ ।| পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ ]

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.