জমি কেনার সময় কি করবেন

জমি ক্রয়ের আগে ক্রেতার করণীয়ঃ পর্ব ২

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

জমিজমা সংক্রান্ত আমাদের দেশে যতো সমস্যা তৈরি হয়, তার বেশির ভাগ সমস্যারই সৃষ্টি হচ্ছে জমি ক্রয়বিক্রয়ের সময়। আপনি জমি ক্রয়ের সময় যদি সচেতনতা অবলম্বন করতে না পারেন, কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে ক্রয় করতে না পারেন, তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ঐ জমির কাগজপত্র নিয়ে আপনাকে বাকী জীবনের কোন না কোন এক সময় ভীষণ পেরেশানির সহিত দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছি, জমি ক্রয়ের পূর্বে কি কি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা জরুরী। আজ আমরা সেই সব বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় সম্বন্ধে একটু বিশদ আলোচনা করবো। আর সেটি হচ্ছে, জমির দলিল। জমি ক্রয়ের পূর্বে জমির বিক্রেতার মালিকানা নিশ্চিত করতে জমির যেসব বিষয়ে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে,  দলিল
যদি জমির বিক্রেতা জমিটি ক্রয় সূত্রে মালিক হয়ে থাকে, তাহলে তার কাছে নিশ্চয়ই পূর্বের দলিল রয়েছে, যেটাকে বলে ভায়া দলিল। আপনাকে ভায়া দলিল গুলোও দেখতে হবে। আপনি যার কাছ থেকে ক্রয় করবেন, তিনি যার কাছ থেকে ক্রয় করেছে, তার আগে কে কার কাছ থেকে ক্রয় করেছে এভাবে অন্তত ৩০ বছর পূর্বে পর্যন্ত কে কে এই জমির মালিক ছিল, তাদের বৈধ কাগজপত্র চেক করে দেখবে হবে। যদিও ৩০ বছর পূর্বে পর্যন্ত ভায়া দলিল যাচাই বাছাই করে দেখতে বলা হয়, তারপরও অনেক সময় দেখা যায় ৩০ বছরেরও আগে কোন একটি ত্রুটি হয়েছিল, যা অনেকেরই চোখে পড়েনি, দাদার করে যাওয়া ভুল বাবার চোখে না পড়লেও নাতির চোখে পড়তেই পারে। তাই, যথাসম্ভব যাচাই বাছাই করে তারপর জমি কিনবেন।
একটা ঘটনা দিয়ে ভায়া দলিলের গুরুত্ব আলোচনা করা যায়, আমি আমার এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটি জমি ক্রয় করবো, আমার প্রতিবেশী নিজেও জমিটি ক্রয় করেছেন বেশি দিন হয়নি। প্রতিবেশী যার কাছ থেকে ক্রয় করেছেন, তিনি আবার ঐ জমির একক মালিক ছিলেন না। যে দলিলের ভিত্তিতে তিনি ঐ সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন, সেই দলিলে তিনি তার ভাইয়ের সাথে যৌথ ভাবে মালিক ছিলেন। কিন্তু, ভাই বিদেশ থাকার কারণে ভাইয়ের অবর্তমানে তিনি একাই পুরো সম্পত্তির মালিক সেজে পুরো সম্পত্তি উক্ত প্রতিবেশীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রতিবেশী জানতে পেরে হোক বা না পেরে হোক, তিনি আমার কাছে ঐ জমি বিক্রি করতে এসেছেন। এখন, আমি যদি শুধু মাত্র আমার প্রতিবেশীর ক্রয় কৃত সাফ কবলা দলিলটি দেখে আমার দলিল তৈরি করি বা যাকে বলে হুবহু দলিল থেকে দলিল করি, তাহলে আমার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চান্স কতটুকু, আপনিই বলুন?
নামাজে যত সুন্দর করেই কেরাত পড়ুন আর রুকু সেজদা ঠিক মতো করুন না কেন, ওযু না করে যদি নামাজ পড়েন, তবে আপনার সেই নামাজ কি হবে?
কেউ জমি ক্রয় করে বাসস্থান করতে, কেউ ক্রয় করে কৃষি কাজ করতে, কেউ আবার বাণিজ্যিক স্থাপনা করতে, কেউবা আবার অলস টাকা ফেলে না রেখে জমিতে বিনিয়োগ করবে বলে জমি ক্রয় করে। কিন্তু, জমি ক্রয় করে ঝামেলা বা হয়রানী হতে হয় না এমন লোকজনের পরিমাণ খুবই কম। তার কারণ হচ্ছে, জমি কেনার যে একটা আকাঙ্ক্ষা বা উত্তেজনা মানুষের মাঝে কাজ করে, সেই উত্তেজনা অনেক সময় মানুষকে অধৈর্য করে তুলে। কখন বিক্রেতাকে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে নিজে জায়গা বুঝে নিবে, এই উত্তেজনায় কাগজপত্র যাচাই বাছাই করার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এর জন্য আরেকটা বিষয়ও দায়ী, মানুষের জমি জমার আইন সম্বন্ধে অজ্ঞতা বা স্বল্প জ্ঞান। জমিজমার বিষয়ে যেহেতু সকল শ্রেণীর মানুষ জড়িত, সেহেতু জমিজমার আইন বা নিয়মকানুন গুলো আসলে সমাজের সকল স্তরের মানুষদের কাছে সরল এবং সহজলভ্য করা উচিত। একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখবেন যে, একটা মানুষ তার পুরো জীবনে কোন দিনও থানা পুলিশ তথা ফৌজদারি মামলায় নাও জড়াতে পারে, কিন্তু জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিটি মানুষকেই জড়াতে হবে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ মাটির উপরই অবস্থান করছে, যদিও মৌলিক চাহিদার তৃতীয়টি হচ্ছে বাসস্থান, কিন্তু মানুষ জঙ্গলে বসবাস করলেও এখন সরকারি খাস জমিতে থাকতে হয়, যেটা কিনা কোথাও কোথাও এখন অনুমতি সাপেক্ষে থাকতে হয়। তারপর প্রথম মৌলিক চাহিদা অন্ন, এই অন্ন আসে কোথা থেকে?- কারো না কারো জমি থেকে। সেটাও এখন মালিকানাধীন। পৃথিবী সৃষ্টির গোড়াতে বা কিছু কাল আগেও মানুষের পরনে জামা কাপড় ছিল না, কিন্তু অন্ন আর বাসস্থান বরাবরই ছিল; ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই, এই জমিজমার সাথে আমাদেরকে সম্পৃক্ত থাকতেই হবে। আর, গণ মানুষের সম্পৃক্ততা যেখানে, সেখানেই নিয়মকানুন থাকবে। সেই নিয়মকানুন আগে জানতে হবে, তারপর মানতে হবে। যেখানে জানার বালাই নেই, সেখানে মানার তো প্রশ্নই উঠে না।
এজন্যই শুরু থেকেই বুঝানোর চেষ্টা করছি যে, জমি কেনার আগে জমির ভায়া দলিল গুলো ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে নিবেন। আপনি নিজে জমিজমার কাগজপত্র বুঝলে তো সমস্যা নাই, কিন্তু যদি না বুঝেন তাহলে দলিল লেখক বা আমীন বা উকিল বা জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে অবগত, এমন কাউকে দিয়ে অবশ্যই ভায়া দলিলগুলো যাচাই বাছাই করে নিবেন। আপনি জানেন, ব্যাংক আপনাকে ঋণ দেওয়ার পূর্বে আপনার যে জমিটি মরগেজ/বন্ধক রাখে, সেই জমির কাগজপত্র যাচাই বাছাই করার জন্য ব্যাংকের প্যানেল উকিল রয়েছে। ব্যাংকাররাও ও তো কম শিক্ষিত নন, তারা নিজেরা জমির কাগজপত্র চেক না করে বাড়তি টাকা খরচ করে কেন প্যানেল উকিলদেরকে দিয়ে চেক করাচ্ছে?- আপনাকে বুঝতে হবে, সবাই সব বিষয়ে অভিজ্ঞ না। পড়াশোনা করা মানুষ যেখানে ঝুঁকি নিচ্ছে না একটা জমি মরগেজ নিতে, আপনি কেন জমি কেনার সময় আপনার এতগুলো টাকা ঝুঁকিতে ফেলবেন?

[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ । পর্ব ৩ ।| পর্ব  ৪ | পর্ব ৫ ।| পর্ব  ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ ]

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.