বিয়ের আগে হবু বউয়ের বয় ফ্রেন্ড আছে কিনা জেনে নিন, নাহলে বিয়ের মঞ্চ থেকে বা বিয়ের পর সংসার করতে করতে হঠাৎ আপনাকে ফেলে বয় ফ্রেন্ডের হাত ধরে পালাবে। তেমনি জমি কেনার আগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিন, উক্ত জমি আপনার আগে অন্য কেউ কেনার জন্য বৈধ ভাবে হকদার আছে কিনা। না হলে জমি কেনার পর দেখবেন জমির দখলে যাওয়ার আগেই কেউ আপনার জমি ছিনিয়ে নিচ্ছে বা জমিতে দখলে গিয়ে কিছু ডেভেলপ করার পরও কেউ এসে মালিক হয়ে যাচ্ছে। এজন্যই আপনার বউ অন্য কারো হাত ধরে পালানোর আগে বউয়ের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিন। টিজারটা কেমন হল? ধামাকা! আসুন এবার পুরো ফিল্ম দেখা যাক।
অনেক আশা ভরসা করে আপনি একটা জমি ক্রয় করলেন, অতঃপর জানতে পারলেন ঐ জমি ক্রয় করার জন্য বিক্রেতার পরিবারের কেউ বা প্রতিবেশী কেউ বা পাশের জমির মালিক অগ্র ক্রয়ের মামলা ঠুকে দিয়েছেন। মানুষ একটা অস্থাবর সম্পত্তিও কতো প্ল্যান করে বা স্বপ্ন দেখে ক্রয় করে। একটা দামি ল্যাপটপ, মোবাইল বা মোটর সাইকেল ক্রয় করার আগেও কতো স্বপ্ন থাকে আমাদের। পছন্দের জিনিসটা ক্রয়ের পর আমাদের মাঝে একরাশ তৃপ্তি এতোটাই ছুঁয়ে যায় যে, মনে হয় যেন পৃথিবীর কাছে আর কোন চাওয়ার নেই। সেখানে আপনি যখন আপনার সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ বা পুরোটা দিয়ে একটা জমি ক্রয় করে বাড়ি করার স্বপ্ন দেখছেন, তখন আপনার সেই জমি কেনার পর বাড়ি করার জন্য প্ল্যান পাস করাচ্ছেন বা ব্যাংক লোণের ব্যবস্থা করছেন, ঠিক তখন যদি কেউ ঐ জমি কেনার জন্য আদালতে মামলা দায়ের করে, তাহলে সেক্ষেত্রে আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হবে, একবার ভেবে দেখেছেন?
আমাদের সমাজে অনেকেই আছে, জেদাজেদির মধ্যে পৈত্রিক সম্পত্তি নিজের ভাইয়ের কাছে বিক্রি না করে বাহিরে বিক্রি করে ফেলি। আবার অনেকে আছে দাদার কাছ থেকে বাবার হাত ধরে পাওয়া সম্পত্তি নিজের চাচাতো জেঠাতো ভাইদের কাছে বিক্রি না করে বাহিরের লোকের কাছে বিক্রি করে। কিন্তু প্রিয়েমশন আইন অনুসারে নিয়ম হচ্ছে, বাহিরের মানুষকে না ঢুকিয়ে যারা আছে তাদের কাছে আগে বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া। কেননা, দশ জনের একটা সমাজে যদি এক জন বাহিরে চলে যেতে চায়, তাহলে বাকী নয় জনের অধিকার আছে চলে যেতে চাওয়া একজনের সম্পত্তি নিজেদের কাছে রেখে দেওয়া। জোর জুলুম করে নয়, বৈধ ভাবে ক্রয় সূত্রে রেখে দেওয়া যেতে পারে। যখন বাকী নয় জনের কেউই রাজি থাকবে না, তখনি কেবল গিয়ে বাহিরের লোকদের কাছে বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু, আমাদের সমাজে দেখা যায় যে, নিজের সম্পত্তি বিক্রির সময় নিজেদের কাছের কেউ এটা ক্রয় করুক এই বিষয়টা আমরা মেনে নিতে পারি না। হিংসায় জ্বলে যাই আমরা। যার ফলে আশেপাশের কাউকে না জানিয়েই বাহিরের কারো কাছে গোপনে বিক্রি করে ফেলি। আর যখনি সেটা জানাজানি হয়, তখনি শুরু হয় বিপত্তি। অনেকেই চায় না তাদের মধ্যে অন্য কোন বাহিরের লোক আসুক, কেননা এতে অনেক সময় ধরণের সামাজিক, সংস্কৃতি-গত, আচার আচরণগত, মন মানসিকতার পার্থক্য সংক্রান্ত অমিলের কারণে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এজন্যই অগ্রক্রয় বা প্রিএমশন। প্রি অর্থ ‘আগে’ আর এমশন অর্থ ‘ক্রয়’। প্রি- এমশন শব্দের অর্থ ‘অগ্রক্রয়াধিকার’। মুসলিম আইনে প্রি- এমশনকে সাফা বলা হয়।
অনেকেই আবার আছে যারা খুব চালাকি করে জমির উপযুক্ত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে, যাতে অগ্রক্রয়ের মামলা করলে বাদী সেই মূল্যে জমি ক্রয় করতে না পারে। এই সব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জমির ক্রেতা বিক্রেতা দুইজনই খুব চতুরতার সাথে জমির হস্তান্তর সম্পন্ন করে আর যখন তৃতীয় কোন ব্যক্তি জানতে পারে, তখন জমির উচ্চ মূল্যের কারণে আর মামলা দায়ের করতে সক্ষম হয় না। এটা যদিও আইনের দৃশটিতে বৈধ (কেননা সাধারণ মানুষ নিজেদের মধ্যে জমি হস্তান্তর করার সময় জমির মূল্য বেশি দেখালে সরকার সেটার উপর কর পাবে, কম দেখালে সেটা বরং কর ফাঁকি)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মামলা করবে কখন?- অগ্রক্রয়ের মামলার বিষয়ে ষ্টেট একুইজিশন এন্ড টিনেন্সি এক্টের ৮৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, জমি হস্তান্তরের নোটিস জারির ৪ মাসের মধ্যে বা যদি নোটিস জারি না হয়ে থাকে তবে জমি হস্তান্তরের বিষয় অবগত হওয়ার তারিখ থেকে ৪ মাসের মধ্যে অগ্রক্রয়ের জন্য অধিকারী ব্যক্তির আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। অগ্রক্রয়ের আবেদনপত্রের সাথে যে মূল্যে জমিটি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ বিক্রয় মূল্য এবং বিক্রয় মূল্যের ১০% ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যাংক চালানের মাধ্যমে জমা দিতে হবে; অন্যথায় আবেদন পত্র বাতিল হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে ক্রেতা হিসেবে আপনি হয়ত ক্রয় মূল্যের সাথে ক্রয় মূল্যের ১০% অতিরিক্ত পাবেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে, কিন্তু টাকা দিয়ে আপনার স্বপ্ন চুরি করে নেওয়ার ক্ষতিপূরণ কেউ দিবে না আপনাকে। তার উপর আমাদের দেশে জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় যে চুরিটা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে, সেটা হল মৌজা রেটের চেয়ে বেশি মূল্য জমি হস্তান্তর হলেও রেজিস্ট্রেশন খরচ বাঁচাতে মৌজা রেটে দলিল রেজিস্ট্রি করা। আপনি যদি রেজিস্ট্রি খরচ বাঁচাতে, জমির প্রকৃত মূল্য গোপন করে মৌজা রেটে জমি রেজিস্ট্রি করে থাকেন, তাহলে আদালতে কিন্তু অগ্রক্রয়ের জন্য যে আবেদন করবে সেই ব্যক্তি মৌজা রেট ধরেই মূল্য পরিশোধ করবে। সুতরাং, সাধু সাবধান। সরকারকেও কর পরিশোধ করুন, নিজেও নিরাপদে থাকুন।
[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ ।| পর্ব ২ | পর্ব ৩ ।| পর্ব ৪ | পর্ব ৫ ।| পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ ]
লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )