বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বা রমনা পার্কে ঢুকার সময় বা মৎস্য ভবনের গলি দিয়ে বের হয়ে শাহবাগের দিকে হওয়ার সময় বা জাতীয় ঈদগাহতে নামাজ পড়ার সময় একটি বহুতল ভবন নিশ্চয়ই আপনার দিকে উঁকি মেরেছে। কিন্তু হয়ত আপনি সেই উঁকি দেখতে পাননি, দেখতে পেলেও হয়ত পাত্তা দেননি, পাত্তা দিলেও আগ্রহ দেখাননি, আগ্রহ দেখালেও হয়ত জানতে পারেননি ঐ ভবনটি আসলে কিসের, কারা থাকে ওখানে, কি করে ওরা, এমন নানাবিধ চিন্তা যদি ঘুণাক্ষরেও আপনার কল্পনার জগতে কোন একদিন এসে থাকে বা উপরের পাঁচ লাইন পড়ার পর এখন মাথায় এসে থাকে, তাহলে আপনি সঠিক জায়গায় ক্লিক করেছেন। পরবর্তী কিছু মিনিট আপনার সাথে সুন্দর কাটবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আপনি যে ভবনটি দেখেছেন, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের (Bangladesh Bar Council)। কি এখন মনে পড়েছে, তাই না?
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল হচ্ছে, বাংলাদেশে থাকা সকল আইনজীবীর অভিভাবক। সকল আইনের ছাত্ররা বিভিন্ন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে আইন পাশ করে, তারপর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষা দেয়, তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে আইন চর্চা করেন। এবার আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ঐ ভবনটির গুরুত্ব কতখানি।
এইতো গেলো, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ইনফর্মাল সংজ্ঞা, সাধারণ মানুষের জন্য। কিন্তু আইনত, The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order, 1972 এই আদেশের বিধান অনুসারে গঠিত বার কাউন্সিল ‘বাংলাদেশ বার কাউন্সিল’ হিসাবে গণ্য হবে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। এটা একটি স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত সংস্থা।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা; রাষ্ট্রপতির ৪৬ নং আদেশ The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order, 1972 এর ৩ অনুচ্ছেদ দ্বারা বার কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে।
আপনার মনে প্রশ্ন এসেছে নিশ্চয়ই, বার কাউন্সিল কারা চালায়?
বার কাউন্সিল পরিচালিত হয় এর সদস্যদের দ্বারা।
তাহলে বার কাউন্সিলের সদস্য কারা?
বার কাউন্সিলের সদস্য হচ্ছে মোট ১৫ জন্য। এর মধ্যে একজন সিলেক্টেড বা পূর্ব নির্ধারিত বা মনোনীত আর বাকি ১৪ জন্য হচ্ছেন ইলেক্টেড বা নির্বাচিত।
নির্বাচিত ১৪ জন সদস্যদের মধ্যে সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত ৭ জন আইনজীবী; এবং ৭ টি গ্রুপে বিভক্ত আঞ্চলিক বার সমিতি হতে নির্বাচিত ৭ জন আইনজীবী।
সাধারণ আসনের ৭ জন আইনজীবী পুরো দেশের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন আর আঞ্চলিক বার সমিতি হতে ৭ জন আইনজীবীকে নির্বাচিত করার জন্য সরকার বার সমিতিগুলোকে ৭টি গ্রুপে বিভক্ত করবে, প্রতি গ্রুপ থেকে ১ জন করে মোট ৭ জন নির্বাচিত হয়ে; এভাবেই বার কাউন্সিলের মোট ১৪ জন সদস্য নির্বাচন করা হয়ে থাকে। আর, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হচ্ছেন সিলেক্টেড বা পূর্ব নির্ধারিত এবং তিনি পদাধিকার বলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট বা সভাপতি।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্যের মেয়াদ কত দিন?
সাধারণত, বার কাউন্সিলের মেয়াদ ৩ বছর। যার ফলে, বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যদের মেয়াদকালও ৩ বছর। আমাদের সংসদের মত, সংসদের মেয়াদ যেমন ৫ বছর, তেমনি একজন এমপি নির্বাচিত হলে ওনারও মেয়াদকাল ৫ বছর (উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম)।
বার কাউন্সিলের ৩ বছরের মেয়াদ শুরু হয় বার কাউন্সিলের সাধারণ নির্বাচনের পর জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে আর বার কাউন্সিলের মেয়াদ শেষ হলে বার কাউন্সিলের সদস্যরাও তাদের পদ হারাবে।
উল্লেখ্য, কোন আইনজীবীই একাধারে বা পরপর বা ধারাবাহিকভাবে ২ (দুই) বারের বেশি বার কাউন্সিলের সদস্য হতে পারবেন না।
তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বার কাউন্সিলের নির্বাচন হয় কবে?
যেহেতু, বার কাউন্সিলের মেয়াদ ৩ বছর, তাই নির্বাচনও হয় ৩ বছর পর পর। এখন, বার কাউন্সিলের সাধারণ নির্বাচন হয় বার কাউন্সিলের মেয়াদ যে বছর শেষ হবে সে বছরের ৩১ মে বা তার আগেই। কিন্তু, বার কাউন্সিলের মেয়াদ শুরু হয় বার কাউন্সিলের সাধারণ নির্বাচনের পর জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে।
মেয়াদ শেষ হওয়া ছাড়া বার কাউন্সিলের সদস্যদের পদ শূন্য হয় না?
একবার নির্বাচিত হয়ে গেলে বার কাউন্সিল সদস্যদের মেয়াদ থাকে ৩ বছর। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে ৩ বছরের পূর্বেই যেকোনো সদস্যের পদ শূন্য হতে পারে, যদি
- কোন সদস্য পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পদ্ধতি হচ্ছে: কোন সদস্য পদত্যাগ করতে চাইলে তাকে বার কাউন্সিলের সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র অর্পণ করে পদত্যাগ করতে হবে।
- আইনজীবীর তালিকা থেকে তাকে অপসারিত করা হলে। যেখানে বার কাউন্সিলের নির্বাচনের পূর্ব শর্তই হচ্ছে উনি কোন না কোন বারের সদস্য হতে হবে, অর্থাৎ আইনজীবী হতে হবে। এখন আইনজীবীই যদি না হয়ে থাকেন, তাহলে বার কাউন্সিলের সদস্য কিভাবে হবেন। তাই, কেউ যদি আইনজীবী থাকাকালীন বার কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন কিন্তু পরক্ষণে আইনজীবীর তালিকা থেকে কোন কারণে ওনার নাম কর্তন বা বাতিল করা হয়, তাহলে আপনাআপনি ওনার বার কাউন্সিলের সদস্য পদও শূন্য হয়ে যাবে।
- বার কাউন্সিলের পরপর ৩টি মিটিং এ অনুপস্থিত থাকলে। তবে, বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অর্থাৎ এটর্নি জেনারেলের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে মিটিং থেকে অনুপস্থিত থাকলে সমস্যা নেই। আবার, প্রথম মিটিং থেকে শেষ মিটিং এর মধ্যে বিরতি ৪ মাসের বেশি হতে হবে, কম হলে হবে না।
- উক্ত সদস্যকে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
- বার কাউন্সিলের কোন সদস্যকে যদি বরখাস্ত করা হয় ১ বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য বা ওনার বরখাস্তের মেয়াদ বার কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে ওনার যে মেয়াদ অবশিষ্ট সেই সম্পূর্ণ মেয়াদের জন্য, তাহলে বার কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে ওনার পদ শূন্য হবে।
আশা করি বুঝতে পেরেছেন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আদৌতে কারা পরিচালনা করে এবং কিভাবে তাদের নির্বাচন করা হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে আমরা বার কাউন্সিলের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )