বায়না দলিল

বায়না দলিলের নমুনা

জমি-জমার আইন

বায়না দলিল কি, কেন, কিভাবে নামক পর্বে আমরা ইতিপূর্বে জানতে পেরেছি যে, বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশন না হলে সেই দলিলের বিপরীতে আইনানুগ সুযোগ সুবিধা পাওয়া সহজলভ্য নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এই বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশন না করার প্রচলন একেবারে ঘরে ঘরে। একটি বাস্তব উদাহরণ টানছি, এই অণুচ্ছেদটি লেখার ঠিক আগের দিন আমি নিজে একটি বায়না দলিলের সাক্ষী হয়েছিলাম। আমার এলাকার দুইজন চাচাতো ভাই নিজেদের মধ্যে সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বায়না করেছে আর দুইজনের পক্ষেই আমি উক্ত টাকা লেনদেন করেছি এবং সাক্ষী ছিলাম। কিন্তু, দলিলটি প্রস্তুত করেছেন আমাদেরই একজন চাচা যিনি কিনা একজন প্রবীণ দলিল লেখক। দলিলটি হাতে লিখা হয়েছে এবং যা যা অনুসরণ করা দরকার একটি বায়না দলিল প্রস্তুত করতে তার পুরোটাই তিনি করেছেন। কিন্তু, উভয় পক্ষের আপত্তিতে দলিলটি আর রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত গড়াবে না বলে তারা জানিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, প্রবাসে থাকাবস্থায় প্রবাসীর অনুকূলে বায়না দলিল করতে আপত্তি থাকলেও আমার যে আত্মীয় বায়না দলিল মূলে ক্রেতা, তিনি কিন্তু প্রবাসেই রয়েছেন। গ্রামে গঞ্জে এই যে অনিয়ম সেটা যতোটা না আবেগে তারচেয়ে অনেক বেশী আইন না জানার কারণে। আজকে যদি বায়না দলিল মূলে যে বিক্রেতা বায়নার টাকা গ্রহণ করেছেন, তিনি যদি উক্ত টাকা মেরে দেন, অর্থাৎ মূল দলিল (সাব কবলা) রেজিস্ট্রেশন করে না দেন, তাহলে কেবলমাত্র সম্পাদিত বায়না দলিল নিয়ে বায়না দলিলের ক্রেতা কতটা আইনের দুয়ারে দুয়ারে দৌড়াতে হবে সেটা আপনি এখন এই অণুচ্ছেদ পড়তে পড়তে উপলব্ধি করতে পারবেন না।

আবার ক্রেতা যদি শেষ পর্যন্ত সম্পত্তি কিনতে রাজি না হয়, তখন বিক্রেতাও ক্রেতাকে আইনত বাধ্য করতে পারবে না, যদি বিক্রেতাকে কোন আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হয় না; সাময়িক ক্রেতা খুঁজে পাওয়ার বিড়ম্বনা ব্যতীত। কিন্তু, অরেজিস্ট্রিকৃত বায়না দলিলের জন্য মোটের উপর ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় ক্রেতাকে। শেষ পর্যন্ত এমনও হতে পারে যে, দুই পক্ষের মধ্যে ঝামেলা লেগে গেছে, তখন গ্রাম্য সালিশ বা থানার মধ্যস্থতায় উক্ত ঝামেলা মীমাংসা করতে হবে যেখানে ক্রেতা তার পুরো টাকা ফেরত না পাওয়ার সম্ভাবনাই শতভাগ; সেটা কেন তা না হয় আর লিখে প্রকাশ করলাম না। তবে, আরও বিভিন্ন উপায়ে ঐ টাকা আদায় করার উপায় রয়েছে যা পরে কখনো সময় করে লিখবো। আবার, দলিল রেজিস্ট্রেশন করবে না জানেন, তখন উক্ত দলিল লেখার সময় কি ধরনের টেকনিক অবলম্বন করলে ক্রেতা তার অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য আইনি প্রতিকার পেতে পারেন, সেটি নিয়েও ভবিষ্যতে লিখবো। অথচ এত ছলচাতুরী না করে তারা যদি এই দলিল সম্পাদনের ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে দুইজনই আইনানুগভাবে বাধ্য থাকবে চুক্তি বলবত করতে। আবার দুইজন মিলে যদি বায়না দলিল বাতিল করতে চায়, সেটাও সম্ভব। আবার এক পক্ষ চাইলের বাতিল আবার অপর পক্ষ চাইলে প্রবলের মামলা করেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সেই সম্বন্ধে আমাদের বায়না দলিল বাতিল ও প্রবলের মামলা অণুচ্ছেদটি পড়ে ধারণা পেতে পারেন।




 

বায়না দলিলের নমুনা নিয়ে আলোচনা করতে এসে কেন বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশন নিয়ে বাড়তি কথা বলছি তা একটু বলে নেই আগে। আজকাল ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে আমরা অনেক কাজ শিখে নিজে নিজে করে ফেলছি। রান্না করা তার মধ্যে বেশ জনপ্রিয় একটি উদাহরণ। রেসিপি দেখে দেখে আমরা বিভিন্ন আইটেম বানানো শিখে নিজেরাই বাসায় ট্রাই করে ফেলছি। কখনো ভালো হচ্ছে, কখনো না মুখেই নেওয়া যায় না। তবে, মোটের উপর বিভিন্ন রেসিপি শেখার জন্য অনলাইনের এইসব টিউটোরিয়াল খুবই কার্যকরী। কিন্তু তার মানে তো এই না যে আপনি ইউটিউবে দেখে দেখে মোটর সাইকেল কিভাবে চালাতে হয় তা শিখে সরাসরি মোটর সাইকেলে উঠে বসলেন হাইওয়ে রাইড দেওয়ার জন্য, সাথে নেই আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স। একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না, নিজের বিপদ তো ঘটাতে পারেনই, পরের জীবনও কেড়ে নিতে পারেন এই স্বল্প জ্ঞান ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন বিহীন কোন কার্যকলাপের জন্য। নিম্নে আমরা বায়না দলিলের একটি নমুনা পিডিএফ আকারে সংযুক্ত করে দিয়েছি যাতে আপনি বায়না দলিল সম্বন্ধে একটি ধারণা পেতে পারেন। তার মানে কিন্তু এই না যে আপনি এই নমুনা দেখে দেখে আপনার কাঙ্ক্ষিত জমির বায়না দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করে ফেলবেন। যার কাজ যেটা তাকে সেটাই করতে দেওয়া উচিত; আপনি শুধু কাজটি সঠিক ভাবে সম্পন্ন হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে নজরদারী করতে পারেন। বহু দলিল লেখক বায়না দলিল করে কিন্তু রেজিস্ট্রেশনের কথা বলে না। আপনি এখন জানতে পারলেন বায়না দলিল সম্পাদনের ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে; এখন আপনি দলিল লেখককে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বলবেন। তারপর বায়না দলিলে সময়সীমা উল্লেখ করতে বলবেন। দাতা এবং গ্রহীতার নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, জন্ম তারিখ, গ্রাম/রোড নং, ইউনিয়ন/ওয়ার্ড, থানা/উপজেলা, জেলা, জাতীয়তা, ধর্ম এই সব কিছু নিজ নিজ জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে সঠিক হয়েছে কিনা। জাতীয় পরিচয় পত্র বলতে এখানে জন্ম নিবন্ধন কার্ড বা ভোটার আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট যেকোনো একটি হলেই চলবে তবে পরের দুইটির যেকোনো একটি থাকলে সেটিই ব্যবহার উত্তম। তারপর তফসীলে গিয়ে জমির সাবেক এবং বর্তমান খতিয়ান নাম্বার, দাগ নাম্বার ঠিক আছে কিনা সেটা বারবার মিলিয়ে নিবেন। কেননা, সবচেয়ে বেশী ভুল এই জায়গায় হয়ে থাকে। শুধু বায়না দলিল না মূল দলিলেও এই তফসীল বারংবার দেখবেন। সবচেয়ে বেশী দলিল সংশোধনের মামলা হয়ে থাকে এই জায়গার ভুলের কারণে।

বহু লোক অভিযোগ করে যে, তাদের দলিলের সবকিছু ঠিক আছে শুধু খতিয়ান নাম্বার বা দাগ নাম্বার ভুল উঠেছে। তাই এই প্যারাটি বারংবার চেক করে দেখবেন। যেই জমিটি ক্রয় করছেন সেই জমির মোট মূল্য যদি এক সাথে আপনাকে বিক্রেতার একাউন্ট নাম্বারে পাঠাতে বলে, তখন ঐ ব্যক্তির একাউন্টে টাকা পাঠানোর সময় আপনি যতটা সতর্ক থাকবেন, একটি ডিজিট ভুলের কারণে টাকা অন্য কারো কাছে চলে যেতে পারে, তেমনি খতিয়ান বা দাগ নাম্বার ভুলের কারণে পুরো জমি নিয়েই আপনি ঝামেলায় পড়ে যাবেন। যাদের ইতিমধ্যে ভুল হয়ে গেছে, তাদের করণীয় নিয়েও আমাদের অণুচ্ছেদ থাকবে, চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে। তারপর জমির পরিমাণটি ঠিক আছে কিনা সেটি দেখবেন। কত শতাংশ বা কত কাঠা জমি ক্রয় করছেন তা ভালো করে দেখুন বা কত স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট ক্রয় করছেন সেটিও যাচাই করুন। বিক্রেতার মালিকানা স্বত্বের ইতিহাসটা ঠিক আছে কিনা সেটিও পরখ করে দেখুন। এরপর চৌহদ্দি দেখবেন, আপনার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে কে বা কি আছে সেটি ঠিক আছে কিনা তাও বাস্তবের সাথে মিলিয়ে নিন। টাকার পরিমাণ কি লিখেছে, কত বায়না হিসেবে পেয়েছে, কত বকেয়া রয়েছে সেগুলোও মিলিয়ে নিন। তারপর দুই পক্ষের সাক্ষী রাখুন। বায়না দলিল বিভিন্ন রকম হতে পারে, তারপরও একটি নমুনা আমরা আপনাদের সুবিধার্থে দিয়ে দিলাম। এটি দেখে দেখে আপনি মিলিয়ে নিতে পারেন, তবে সব বায়না দলিল ঠিক এমনি হতে হবে তা কিন্তু নয়।

অতএব, পড়ুন, দেখুন, জানুন; তারপর যাচাই করুন। দেখবেন ঠকবার সম্ভাবনা কমে গেছে, ইনশাআল্লাহ্‌।

বায়না দলিলের নমুনা সংযুক্তিটি ডাউনলোড করুনঃ

Download
PDF File Size: 821 KB
close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.