জমিজমা সংক্রান্ত আমাদের দেশে যতো সমস্যা তৈরি হয়, তার বেশির ভাগ সমস্যারই সৃষ্টি হচ্ছে জমি ক্রয়বিক্রয়ের সময়। আপনি জমি ক্রয়ের সময় যদি সচেতনতা অবলম্বন করতে না পারেন, কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে ক্রয় করতে না পারেন, তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ঐ জমির কাগজপত্র নিয়ে আপনাকে বাকী জীবনের কোন না কোন এক সময় ভীষণ পেরেশানির সহিত দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
আমরা একটা জমি ক্রয় করতে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করতে রাজি কিন্তু জমি ক্রয় করার আগে কাগজ পত্রগুলো যাচাই বাছাই করার জন্য পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা খরচ করতে রাজি হই না। এটা অনেকটাই লাখ টাকা খরচ করে ঘোড়া কিনার মত, যে ঘোড়ার গলায় সামান্য কয় টাকার দড়ি নেই। দড়ি হীন ঘোড়ার মালিকানা নির্ধারণ করা কতো মুশকিল সেটা একবার ঘোড়া কিনে ঘোড়ার দড়ি খুলে ফেললেই বুঝবেন। বলা বাহুল্য, ঘোড়াকে সম্ভবত দড়ি নয়, বরং বেল্ট পরানো হয়।
জমি কেনার আগের যে দলিল লেখক দলিলটি লিখবেন, তিনি যথাসম্ভব দলিলটি প্রস্তুতে যেসব কাগজপত্র রয়েছে সেগুলো যাচাই বাছাই করে থাকেন, কিন্তু তারপরও এমন সব বিষয় আছে যেগুলো দলিল লেখকের দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না আবার দলিল লেখক যে সব বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন হবেন তাও কিন্তু নয়। আবার অনেক দলিল করা হয় দলিল থেকে দলিল, তখন দলিল লেখকের আর বাড়তি কাগজপত্র যাচাই বাছাই করতে হয় না, যার ফলে অতীতের কোন ভুল ত্রুটি থেকে থাকলে তা সংশোধন তো করাই হয় না বরং ঝামেলা আরও জটিল হয়ে যায় পক্ষগণ বৃদ্ধির বদলতে।
জমি কেনার আগে বিক্রেতা আপনার সাথে যত সুন্দর ব্যবহার করবেন, টাকা বুঝে পাওয়ার পর বিক্রেতার চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে; পাল্টে যাওয়াই স্বাভাবিক। বেচারার জমি চলে গেলে আপনার কাছে এখন আবার আপনার জমির ভুলভ্রান্তিও সংশোধন বেচারাকে সংশোধন করতে হবে, এটা কি মেনে নেওয়া যায়? অবশ্যই যায় না; আপনি যতো টাকা দিয়েই ক্রয় করুন না কেন, জমির বিক্রেতার দায়িত্ব নয় আপনার জমির আইনানুগ সমস্যাগুলো তিনি সমাধান করে দিবেন। তিনি ইচ্ছে করলে পারেন, কিন্তু তাকে বাধ্য করে করানো সম্ভব না। কারণ, তখন সেটি আপনার ক্রয় কৃত জমি, আপনাকেই সমাধান করতে হবে। আমার নিছক এই খোঁচা যদি আপনি বুঝতে পারেন তাহলে এটাও বুঝতে আর বাকী নেই যে, জমি কেনার আগে জমির মালিককে দিয়ে সকল সমস্যা সমাধান করানো উচিত; বিক্রেতা নিজে জমিকে ভুল ভ্রান্তি মুক্ত করতে না পারলে জমি কেনার দরকার নাই। কথায়ই তো আছে, দুষ্টু গরুর চেয়ে, শূন্য গোয়াল ভালো।
আজকে প্রথম পর্বে কোন একটি টপিক নিয়ে বিশদ আলোচনা না করলেও কি কি বিষয় যাচাই বাছাই করা উচিত, সেগুলো সম্বন্ধে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো। বুলেট পয়েন্টের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করবো, যে বিষয় গুলো যাচাই বাছাই না করে জমি ক্রয় করলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে:
• জমি দলিল: যদি জমির বিক্রেতা জমিটি ক্রয় সূত্রে মালিক হয়ে থাকে, তাহলে তার কাছে নিশ্চয় পূর্বের দলিল রয়েছে, আপনাকে সেগুলো দেখতে হবে। অন্তত ৩০ বছর পূর্বে পর্যন্ত কে কে এই জমির মালিক ছিল, তাদের বৈধ কাগজপত্র চেক করে দেখবে হবে।
• খতিয়ান সূত্রে মালিক: অনেক জমির মালিক আছে, যাদের কোন দলিল নেই। তারা রেকর্ড সূত্রে বা খতিয়ান সূত্রে মালিক। তাদের খতিয়ান গুলো আপনাকে দেখতে হবে। সিএস খতিয়ান থেকে শুরু করে বিএস খতিয়ান পর্যন্ত আপনাকে চেক করে দেখতে হবে যে, তিনি প্রকৃতপক্ষেই রেকর্ড সূত্রে মালিক কিনা।
• দখল: জমির বিক্রেতার দলিল, খতিয়ান ঠিক থাকার পরও অনেক মালিক জমিতে যেতে পারে না; কারণ দখল নিয়ে তাদের ঝামেলা রয়েছে। কারো পুরো জমিরই দখল নেই, কারো বা আংশিক দখল নেই। টাকা দিয়ে জমির কাগজ কিনবেন, জমিতে তো আপনাকে যেতে হবে, নাকি?
• সার্ভেয়ার/ আমীন: ৫ শতক জায়গা কিনলেন ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করে। কিন্তু, জায়গাতে গিয়ে দেখলেন জায়গা আছে, ৪.৫ শতক। চারপাশে বাড়ি উঠায় সবাই একটু একটু করে ছাপতে ছাপতে আপনার আধা শতক জায়গা ছেপে দিয়েছে। দাম কতো পড়ল আধা শতকের ?- ৫ লক্ষ টাকা। অথচ ৫,০০০/- টাকা খরচ করে আমীন দিয়ে জমিটা মাপিয়ে নিতে পারতেন, ৪,৯৫,০০০/- টাকা বেছে যেত।
• খারিজ/ নামজারিঃ জমি কেনার পর জমিটি ভূমি অফিস থেকে খারিজ/ নামজারি করাতে পারবেন কিনা সেটা নিশ্চিত না হয়ে জমি কেনার পর ভূমি অফিসে আবার দিনের পর দিন ঘুরতে হয় নামজারির জন্য?
• মামলা: বিয়ে করলে শালী ফ্রি, একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি। জমি তো কিনেছেন সাথে মামলা ফ্রি কিনা সেটা কেনার আগে যাচাই করে দেখুন।
• অগ্রক্রয়ঃ বিয়ের আগে হবু বউয়ের বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা জেনে নিন, নাহলে বিয়ের মঞ্চ থেকে বা বিয়ের সংসার করতে করতে হঠাৎ আপনাকে ফেলে বয়ফ্রেন্ডের হাত পালাবে। তেমনি জমি কেনার আগে দেখুন এই জমি আপনার আগে অন্য কেউ কেনার জন্য বৈধ ভাবে হকদার কিনা।
• অংশীদার: যে জমি ক্রয় করছেন, সেটি বিক্রেতার একক মালিকানাধীন জমি নাকি আরও মালিক আছে, এজমালি সম্পত্তি কিনা এসবও যাচাই বাছাই করুন।
• নাবালকের সম্পত্তি: নাবালক সম্পত্তি বিক্রি করতে পারে না তবে নাবালকের সম্পত্তি আদালতের অনুমতি নিয়ে অভিভাবক বিক্রি করতে পারে। আদালতের অনুমতি আছে কিনা সেটাও দেখতে হবে।
এছাড়াও লীজ, ওয়াকফসহ আরও অনেকগুলো ছোটখাটো বিষয় আছে যেগুলো যাচাই বাছাই করে দেখে তারপর জমি কেনা উচিত। বায়নাপত্র করার পর অনেকে জমির ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়, এটাও ঠিক না। বায়নার টাকা দিয়ে দেওয়ার পর যদি জমিতে সমস্যা আছে, এটা টের পান, তাহলে ঐ টাকা উদ্ধার করতে কম ভোগান্তি হবে আপনার?
টাকা আরেকজনের পকেটে গেলে সেটা তার হয়ে যায়। তাই, টাকা পয়সা লেনদেন করার আগে, জমির বিষয়ে সুনিশ্চিত হয়ে নিন; তারপর ক্রয় করুন। উপরের বুলেট পয়েন্ট গুলো আরও বিস্তারিত ভাবে লিখবো পরের আর্টিকেল গুলোতে। সেখান থেকে নিজে নিজেই বুঝতে পারবেন, কোনটা কীভাবে যাচাই বাছাই করতে হবে।
[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ ।| পর্ব ৪ | পর্ব ৫ ।| পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ ]
লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )