এজমালি শব্দটির সাথে যারা এখনো পরিচিত নন, আজকে শুরুতেই তাদেরকে এজমালি সম্বন্ধে বিস্তারিত বলে রাখতে চাই। পুরো পর্বেই এই শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হবে এবং এই শব্দের মর্মার্থ না বুঝলে এই পর্বটিই বুঝা সম্ভব না; ফলে জমি কেনার সময় সচেতন না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এজমালি শব্দের অর্থ হচ্ছে যৌথ ভাবে মালিক এবং যৌথভাবে ব্যবহার্য। কোন সম্পত্তি যদি বলা হয় যে, এজমালি সম্পত্তি, তাহলে বুঝতে হবে এই সম্পত্তিটি একক মালিকানাধীন নয়। একের অধিক মালিক রয়েছে এবং সকল মালিকই ঐ সম্পত্তি ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে গ্রামে দেখে থাকবেন পুকুর বা উঠান, এগুলো খুব কম সংখ্যক পরিবারেরই একক হয়ে থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পুকুর বা উঠান এগুলো পুরো বাড়ির বা কয়েকটি পরিবারের যৌথ মালিকানাধীন হয়ে থাকে এবং যৌথ মালিকরাই ব্যবহার করে থাকে। এখন কথা হচ্ছে, এই যৌথ বা এজমালি সম্পত্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কি সমস্যা?
শুধু পুকুর বা উঠান/ আঙিনা নয়, পুরো বাড়ি বা কৃষি, অ-কৃষি জমিও এজমালি বা যৌথ থাকে। এই যৌথ সম্পত্তি অনেক সময় যৌথ মালিকানার মধ্যে যেকোনো একজন মালিক নিজের প্রয়োজনে বিক্রি করার ইচ্ছে পোষণ করতে পারে। আগের পর্বে আমরা প্রি-এমশন বা অগ্রক্রয় নিয়ে আলোচনা করেছি, যৌথ মালিকদের মধ্যে যে মালিক বিক্রি করতে চাইবে সে প্রথমে বাকি সকল অংশীদারদেরকে জানাবে তাদের মাঝে কেউ ক্রয় করতে ইচ্ছুক কিনা। যদি তাদের মাঝে কেউ ক্রয় করতে রাজি হয়, তাহলে তো লেটা ছুঁকে গেলো। কিন্তু তাদের মাঝে কেউ যদি ক্রয় করতে ইচ্ছে পোষণ না করে, তবে তখন বাহিরের লোকের কাছে বিক্রি করতে হবে। এখন ধরুন, বাহিরের লোক বলতে আপনাকে জমিটি ক্রয় করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হল, রাস্তার পাশের জমি দেখে আপনারও পছন্দ হল। যেই দেখা সেই কাজ, আপনিও লেনদেন করে জমি ক্রয় করে ফেললেন। কিন্তু যখনি আপনি দখলে যেতে চাইবেন, তখনি শুরু হয়ে যাবে বিপত্তি। আগের পর্ব গুলোর মধ্যে যেখানে জমি মেপে কেনা উচিত বা দখল নির্ধারণ করে জমি ক্রয় করা উচিত বলে লিখেছিলাম, সেগুলোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত উদাহরণ হচ্ছে এই এজমালি সম্পত্তি ক্রয়। যেহেতু একটি জমিতে ২ ভাই বা একের অধিক যেকোনো সংখ্যার মালিক রয়েছে, সেহেতু জমিটি ক্রয় করার সময় জমির কোন পাশে কোন ভাইয়ের বা কোন মালিকের সম্পত্তি সেটা নির্ধারণ করা না থাকলে আপনি ক্রয় করে অবশ্যই বিপত্তিতে পড়বেন।
অতীতে গ্রামের মুরুব্বীরা জমি ক্রয়ের সময় কখনো রাস্তার পাশের জমি ক্রয় করতো না। ওনাদের যুক্তিটিও ছিল তখনকার সময় অনুসারে যুগোপযোগী। কেননা, তখনকার বেশিরভাগ জমিই ছিল কৃষি জমি আর রাস্তার পাশের কৃষি জমিগুলোতে ধান তথা ফসল কম হতো। তার উপর ফসল চুরি হয়ে যেত। আবার অনেকেই যারা নতুন বাড়ি করার জন্যও জমি ক্রয় করতো তারাও রাস্তার পাশে বাড়ির জন্য জমি কিনতে আগ্রহী ছিল না। কেননা, রাস্তার পাশে বাড়ি মানে যেকোনো সময় ডাকাতির ভয় ছিল। তখনকার আইন শৃঙ্খলা অবশ্যই এখনকার মত ছিল না। যার ফলে রাস্তার পাশের জমি বা বাড়ি থেকে কিছু দূরের জমি তারা ক্রয় করতো না। আর যদি কারো পৈত্রিক জমি থাকতো রাস্তার পাশে বা বাড়ি থেকে কিছু দূরে তাহলে সেই জমি তারা হয় উত্তরাধিকার সূত্রে বোনদের দিয়ে দিতো বা বিক্রি করে দিয়ে নিজের আশেপাশে ক্রয় করার চেষ্টা করতো বা এওয়াজ বদল করতো বা খিল্লা তথা খালি ফেলে রাখতো।
উপরে এই ইতিহাস বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাস্তার পাশের জমি বা রাস্তা থেকে এক জমি পরে যখন কোন জমি ক্রয় করবেন, তখন আপনাকে যে বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হতে হবে সেটি হচ্ছে রাস্তা। জমি একটুখানি ভেতরে হলেও কোন সমস্যা নাই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যদি জমিতে যাওয়ার রাস্তা না থাকে। আপনার জমির নীচে যদি স্বর্ণের খনিও থাকে, কিন্তু জমিতে যাওয়ার রাস্তা না থাকে, তাহলে সেই স্বর্ণ আপনি উদ্ধার করে আনতে পারবেন না, বসতি স্থাপন তো অনেক পরের কথা। আশেপাশে খবর নিলে জানতে পারবেন যে, শুধু রাস্তার অভাবে বিল্ডিং এর কাজ করতে কতো মানুষকে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। কেউ ডিরেক্ট ইট, বালি, সিমেন্টের গাড়ি নিজ জায়গা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে, আর কেউ নিজ জায়গা থেকে দূরে রেখে আবার লেবার দিয়ে বয়ে নিয়ে আসছে, যাতে কিনা বাড়তি খরচ বহন করতে হচ্ছে। এজমালি জায়গা ক্রয় করলে এই ধরনের সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অনেকেই আছে, নিজেদের মধ্যে বণ্টন সম্পন্ন না করেই জমি ক্রয় করে খতিয়ানে নিজের অংশ বা হিস্যা অনুসারে, এখন খতিয়ানে তো আর চৌহদ্দি উল্লেখ থাকে না, ফলে যে ক্রয় করে সে চৌহদ্দি নিয়ে বেকায়দায় পড়ে। বিক্রেতা যদি একটু শক্তিধর হয়, তাহলে হয়ত ক্রেতাকে জায়গাটা সীমানা নির্ধারণ করে চৌহদ্দি ঠিক করে দেয়, কিন্তু যে বিক্রেতা খতিয়ানের বাকি মালিকদের থেকে দুর্বল হয় আর সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে ক্রেতা চৌহদ্দি নিয়ে বিক্রেতা বা তার অংশীদারদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হয় অনেকদিন। তাই, জমিটি কি আপনাকে আপনার মন মত স্কয়ার করে দিচ্ছে নাকি ওনাদের মন মত লম্বা কবরস্থান বানিয়ে দিচ্ছে, সেই বিষয়টাও আপনাকে নিশ্চিত করে তারপর বায়না চুক্তি করতে হবে, এর আগে লেনদেন করলেই আপনি ধরা খেয়ে যেতে পারেন।
[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ ।| পর্ব ২ | পর্ব ৩ ।| পর্ব ৪ | পর্ব ৫ ।| পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ১০ ]
লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )